‘ক্রাইম পেট্রল’ দেখে শিশু আয়াত হত্যা: ফের আবিরের আরো ৭ দিনের রিমান্ড
এসএম শামসুজ্জোহা
২৯ নভেম্বর, ২০২২, 12:17 AM
‘ক্রাইম পেট্রল’ দেখে শিশু আয়াত হত্যা: ফের আবিরের আরো ৭ দিনের রিমান্ড
বিনোদনের অন্যতম প্রভাবশালী মাধ্যম সিনেমা-সিরিজ দেখে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। শিক্ষার অন্যতম এই উপকরণ সুশিক্ষায় কাজে না লাগিয়ে ব্যবহার হচ্ছে কুশিক্ষায়। সিনেমার ‘অ্যাকশন’, ‘ক্রাইম’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে প্রভাবিত হয়ে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগের চেষ্টা করছে উঠতি বয়সী তরুণরা।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের হাতে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার ও আটক হওয়া কয়েকজনের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। পুলিশ, ঘটনার সাক্ষী, পরিবার, ঘটনার শিকার ব্যক্তি- এরকম বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঘটনা যেভাবে ঘটেছে এসব বিষয় জানতে পেরেছে। আটক হওয়া কয়েক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি জবানবন্দি সূত্র ধরে পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডির গল্প বা হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখে নৃশংস হত্যা, ভয়ঙ্কর খুনের নানা পরিকল্পণাসহ আলামত নষ্ট করার বিদ্যা রপ্ত করছে অপরাধীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশকটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অপরাধবিষয়ক তথ্যচিত্র শিশুদের মনে প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে কিশোরদের ওপর। কিশোর বয়সে ভালোমন্দের বিবেচনাবোধ না থাকায় মঞ্চস্থ ঘটনাগুলোকে উত্তেজনাকর বলে মনে করেন তারা। সমাজে অপরাধে নৃশংসতা বাড়ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরতা বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন দরিদ্রতা, হতাশা ও শূন্যতা বেড়েছে। এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি। যার ফলে নৃশংস হত্যা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে টার্গেট কিলিং ও অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে হত্যাসহ পরিকল্পিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে দেশে গত দুই বছরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে- গত বছরের অক্টোবরে সাতক্ষীরায় ছোট ভাইয়ের হাতে দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ বড় ভাই হত্যাকাণ্ড, একই মাসে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে আলোচিত জোড়া খুন (মা-ছেলেকে), ২০১৯ সালের জুনে পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ১৩ বছরের এক কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা, একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় টাকা না পেয়ে ভাবিকে হত্যা। এছাড়া ২০১৯ সালের মার্চে কেরানীগঞ্জে এবং এপ্রিলে সাভারের ভাকুর্তায় দুই রিকশাচালকের হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনাগুলোয় জড়িতদের বেশিরভাগই কৈশোর বয়স অতিক্রম করেছে। কিন্তু সম্প্রতি চট্রগ্রামে শিশু আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল একজন কিশোর।
অতীতে শুধু ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে অপরাধে জড়ানোর খবর এলেও এবার হয়েছে হিন্দি সিনেমা দেখে। হিন্দি সিনেমা ‘ধুম-৩’ ১৫৪ বার দেখে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ শ্বাসরোধে শিশু আয়াতের মৃত্যুর পর তার মরদেহ বাবার বাসায় পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে নিজ বাসায় নিয়ে যান আবির। পরে খুনি সেখানে আমির খানের অভিনয়ের নানা কৌশল ও ‘অ্যাকশন’ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে বটি ও অ্যান্টি-কাটার দিয়ে মরদেহ ছয় টুকরো করে দুটি পলিথিনে নিয়ে চট্টগ্রামের সাগরপাড় এলাকায় সাগরে ফেলে দেয়।
অপরদিকে শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত চট্রগ্রাম ইপিজেড এলাকা থেকে নিখোঁজের ১০ দিন পর খুনের রহস্য উদঘাটিত হয় এবং খুন হয় পরিচিত এক তরুণের হাতে। পরে এ ঘটনায় জড়িত এজারভুক্ত আসামী আবিরকে গত শুক্রবার ২৫ নভেম্বর আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নিহত আয়াতের বাবা সোহেল রানাদের বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন হত্যাকারি আবির মিয়া নামের এই তরুণ। পাঁচ বছরের শিশু আয়াতকে হত্যা ও এরপর লাশ ছয় টুকরো করার অভিযোগে মামলার বাদী সোহেল রানার করা এজাহারভুক্ত আসামীর আবির মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গত শনিবার আদালত প্রথমে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তদন্ত শেষে সোমবার দ্বিতীয় দফায় ফের আরো ৭ দিনের রিমান্ডদেন বলে চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক ইলিয়াস খান প্রভাতী খবরকে নিশ্চিত করেন।
শিশু আয়াত খুনের ঘটনা নিয়ে পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশুটিকে অপহরণ করেছিল আবীর। একপর্যায়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। মরদেহ গুম করতে টুকরো করা হয় এবং প্যাকেটে মুড়িয়ে সাগর ও খালের ২টি জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে হত্যাকাণ্ড ও আলামত লুকিয়ে ফেলার এমন নৃশংস ও ভয়ঙ্কর কৌশল রপ্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে আবীর।’
তদন্তকারীর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি (আবীর) জানিয়েছে, শিশু আয়াতকে অপহরণ করে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু তার মুঠোফোনের সিম কাজ না করায় শিশুটির পরিবারকে ফোন দিতে পারেননি। নিজে ধরা পড়ে যাবেন এ ভয়ে শিশুটিকে কেটে ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেন। ভারতীয় টিভি সিরিজ ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে আবির এ কাজ করার কথা স্বীকার করেন।
আবিরের বাবা ভ্যানচালক আজহারুল ইসলাম শিশু আয়াতের বাসায় ভাড়া থাকেন। তার মা আলো বেগম পোশাক কারখানা শ্রমিক। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় আলো বেগম ইপিজেড এলাকার আকমল আলী রোড এলাকায় অন্য বাসায় থাকেন। মা ও বাবার দুটি বাসাতে যাতায়াত ছিল আবিরের।
শিশু আয়াতকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা আবির দুই মাস আগে করেন। আর মুক্তিপনের টাকা দিয়ে নিজের ও মায়ের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল বেকার আবিরের। আর বেকার থাকা অবস্থায় তার টাকার দরকার ছিল। সে সিএনজি কিনে তা দিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছিল।
১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা ওয়াজ মুন্সিবাড়ি এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আয়াত বাসার পাশে একটি মক্তবে বিকেলে পড়তে যায়। পরে পরিবার জানতে পারে শিশুটি মক্তবে যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ইপিজেড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। পরে জিডিটি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় রূপান্তর করা হয়।
গতকাল দুপুরে ওয়াজ মুন্সিবাড়ি এলাকায় সোহেল রানার বাসায় গিয়ে দেখা যায় তালাবদ্ধ। ঘটনার পর থেকে থাকছেন পাশে তার (সোহেল রানা) নানার বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে পাওয়া যায় আয়াতের মা তামান্নাকে।
কথা হয় আয়াতের ফুফু আলভিনা আক্তারের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে শোনার পর থেকে নির্বাক হয়ে আছেন ভাবি। খাওয়াদাওয়া অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেন।
আয়াতের বাবা সোহেল রানা বাড়ির পাশে একটি মুদির দোকান করেন। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত তিনি। মেয়েকে হারিয়ে অসুস্থতা আরও বেড়েছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে গতকাল ছুটে যান নগরের আকমল আলী রোড–সংলগ্ন সাগরপারে পিবিআইয়ের অভিযানে। যদি মেয়ের লাশের একটি টুকরাও পাওয়া যায়। শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে বুকের ধনকে অন্তত দাফন করতে পারবেন। মুদি দোকানী সোহেল রানা বলেন, ‘জানাজা পড়ার জন্য মেয়ের লাশটাও পাইনি। মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’
আলিনা নিখোঁজ হলে ১০ দিন পর্যন্ত মা–বাবা অপেক্ষায় ছিলেন, এই বোধ হয় মেয়ে ঘরে ফিরল। কিন্তু মা–বাবা এখন জেনে গেছেন তাদের কলিজার টুকরা মেয়েকে কয়েক টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মেয়েটির স্বজনেরা সাগরপাড়ে ছুটছেন, যদি তার শরীরের কোনো টুকরা, জামা, জুতা, হিজাব বা অন্য কিছু পাওয়া যায়, সে আশায়। আলিনার বাবা মো. সোহেল রানা মুঠোফোনে বললেন, ‘কলিজার শরীরের একটা টুকরাও যদি পাইতাম, দাফনটা তো করতে পারতাম। কলিজার তো কিছুই পাইলাম না।’
তিনি বললেন, সাগরপাড়ে গিয়ে তারা আলিনার যদি কোনো আলামত পাওয়া যায়, তাই খুঁজছেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘আমার মেয়েটা আমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে লুকোচুরি খেলত। ঘটনার দিনও দোকানে বসে তার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। মেয়েটা আচার খেতে চায়। মেয়ের তো আচার খাওয়া শেষ, আর খাবে না।’
শিশু আয়াত খুনের ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা প্রভাতী খবরকে মোবাইলে বলেন, সোমবার দুপুরে আসামী আবিরকে নিয়ে নিয়ে নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোড ও সাগরপাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বটি ও শিশুটির পায়ের স্যান্ডেলসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু, শিশুটির মরদেহের টুকরোর খোঁজ এখনো মেলেনি। পুলিশের ধারণা, মরদেহের টুকরোগুলো জোয়ার-ভাটায় সাগরে ভেসে গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরভাবে খুনের ঘটনা অনেক সময় বেড়ে যায়। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে; না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও অনেক সময় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে। লোভ-লালসা বা টাকার প্রয়োজনে মানুষ খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধও করে। সবার উচিত এদিকে দৃষ্টি দেয়া।
এসএম শামসুজ্জোহা
২৯ নভেম্বর, ২০২২, 12:17 AM
বিনোদনের অন্যতম প্রভাবশালী মাধ্যম সিনেমা-সিরিজ দেখে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। শিক্ষার অন্যতম এই উপকরণ সুশিক্ষায় কাজে না লাগিয়ে ব্যবহার হচ্ছে কুশিক্ষায়। সিনেমার ‘অ্যাকশন’, ‘ক্রাইম’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে প্রভাবিত হয়ে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগের চেষ্টা করছে উঠতি বয়সী তরুণরা।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের হাতে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার ও আটক হওয়া কয়েকজনের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। পুলিশ, ঘটনার সাক্ষী, পরিবার, ঘটনার শিকার ব্যক্তি- এরকম বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঘটনা যেভাবে ঘটেছে এসব বিষয় জানতে পেরেছে। আটক হওয়া কয়েক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি জবানবন্দি সূত্র ধরে পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডির গল্প বা হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখে নৃশংস হত্যা, ভয়ঙ্কর খুনের নানা পরিকল্পণাসহ আলামত নষ্ট করার বিদ্যা রপ্ত করছে অপরাধীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশকটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অপরাধবিষয়ক তথ্যচিত্র শিশুদের মনে প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে কিশোরদের ওপর। কিশোর বয়সে ভালোমন্দের বিবেচনাবোধ না থাকায় মঞ্চস্থ ঘটনাগুলোকে উত্তেজনাকর বলে মনে করেন তারা। সমাজে অপরাধে নৃশংসতা বাড়ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরতা বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন দরিদ্রতা, হতাশা ও শূন্যতা বেড়েছে। এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি। যার ফলে নৃশংস হত্যা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে টার্গেট কিলিং ও অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে হত্যাসহ পরিকল্পিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে দেশে গত দুই বছরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে- গত বছরের অক্টোবরে সাতক্ষীরায় ছোট ভাইয়ের হাতে দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ বড় ভাই হত্যাকাণ্ড, একই মাসে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে আলোচিত জোড়া খুন (মা-ছেলেকে), ২০১৯ সালের জুনে পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ১৩ বছরের এক কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা, একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় টাকা না পেয়ে ভাবিকে হত্যা। এছাড়া ২০১৯ সালের মার্চে কেরানীগঞ্জে এবং এপ্রিলে সাভারের ভাকুর্তায় দুই রিকশাচালকের হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনাগুলোয় জড়িতদের বেশিরভাগই কৈশোর বয়স অতিক্রম করেছে। কিন্তু সম্প্রতি চট্রগ্রামে শিশু আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল একজন কিশোর।
অতীতে শুধু ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে অপরাধে জড়ানোর খবর এলেও এবার হয়েছে হিন্দি সিনেমা দেখে। হিন্দি সিনেমা ‘ধুম-৩’ ১৫৪ বার দেখে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ শ্বাসরোধে শিশু আয়াতের মৃত্যুর পর তার মরদেহ বাবার বাসায় পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে নিজ বাসায় নিয়ে যান আবির। পরে খুনি সেখানে আমির খানের অভিনয়ের নানা কৌশল ও ‘অ্যাকশন’ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে বটি ও অ্যান্টি-কাটার দিয়ে মরদেহ ছয় টুকরো করে দুটি পলিথিনে নিয়ে চট্টগ্রামের সাগরপাড় এলাকায় সাগরে ফেলে দেয়।
অপরদিকে শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত চট্রগ্রাম ইপিজেড এলাকা থেকে নিখোঁজের ১০ দিন পর খুনের রহস্য উদঘাটিত হয় এবং খুন হয় পরিচিত এক তরুণের হাতে। পরে এ ঘটনায় জড়িত এজারভুক্ত আসামী আবিরকে গত শুক্রবার ২৫ নভেম্বর আটক করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নিহত আয়াতের বাবা সোহেল রানাদের বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন হত্যাকারি আবির মিয়া নামের এই তরুণ। পাঁচ বছরের শিশু আয়াতকে হত্যা ও এরপর লাশ ছয় টুকরো করার অভিযোগে মামলার বাদী সোহেল রানার করা এজাহারভুক্ত আসামীর আবির মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গত শনিবার আদালত প্রথমে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তদন্ত শেষে সোমবার দ্বিতীয় দফায় ফের আরো ৭ দিনের রিমান্ডদেন বলে চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক ইলিয়াস খান প্রভাতী খবরকে নিশ্চিত করেন।
শিশু আয়াত খুনের ঘটনা নিয়ে পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশুটিকে অপহরণ করেছিল আবীর। একপর্যায়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। মরদেহ গুম করতে টুকরো করা হয় এবং প্যাকেটে মুড়িয়ে সাগর ও খালের ২টি জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে হত্যাকাণ্ড ও আলামত লুকিয়ে ফেলার এমন নৃশংস ও ভয়ঙ্কর কৌশল রপ্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে আবীর।’
তদন্তকারীর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি (আবীর) জানিয়েছে, শিশু আয়াতকে অপহরণ করে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু তার মুঠোফোনের সিম কাজ না করায় শিশুটির পরিবারকে ফোন দিতে পারেননি। নিজে ধরা পড়ে যাবেন এ ভয়ে শিশুটিকে কেটে ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেন। ভারতীয় টিভি সিরিজ ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে আবির এ কাজ করার কথা স্বীকার করেন।
আবিরের বাবা ভ্যানচালক আজহারুল ইসলাম শিশু আয়াতের বাসায় ভাড়া থাকেন। তার মা আলো বেগম পোশাক কারখানা শ্রমিক। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় আলো বেগম ইপিজেড এলাকার আকমল আলী রোড এলাকায় অন্য বাসায় থাকেন। মা ও বাবার দুটি বাসাতে যাতায়াত ছিল আবিরের।
শিশু আয়াতকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা আবির দুই মাস আগে করেন। আর মুক্তিপনের টাকা দিয়ে নিজের ও মায়ের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল বেকার আবিরের। আর বেকার থাকা অবস্থায় তার টাকার দরকার ছিল। সে সিএনজি কিনে তা দিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছিল।
১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা ওয়াজ মুন্সিবাড়ি এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আয়াত বাসার পাশে একটি মক্তবে বিকেলে পড়তে যায়। পরে পরিবার জানতে পারে শিশুটি মক্তবে যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ইপিজেড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। পরে জিডিটি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় রূপান্তর করা হয়।
গতকাল দুপুরে ওয়াজ মুন্সিবাড়ি এলাকায় সোহেল রানার বাসায় গিয়ে দেখা যায় তালাবদ্ধ। ঘটনার পর থেকে থাকছেন পাশে তার (সোহেল রানা) নানার বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে পাওয়া যায় আয়াতের মা তামান্নাকে।
কথা হয় আয়াতের ফুফু আলভিনা আক্তারের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে শোনার পর থেকে নির্বাক হয়ে আছেন ভাবি। খাওয়াদাওয়া অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেন।
আয়াতের বাবা সোহেল রানা বাড়ির পাশে একটি মুদির দোকান করেন। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত তিনি। মেয়েকে হারিয়ে অসুস্থতা আরও বেড়েছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে গতকাল ছুটে যান নগরের আকমল আলী রোড–সংলগ্ন সাগরপারে পিবিআইয়ের অভিযানে। যদি মেয়ের লাশের একটি টুকরাও পাওয়া যায়। শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে বুকের ধনকে অন্তত দাফন করতে পারবেন। মুদি দোকানী সোহেল রানা বলেন, ‘জানাজা পড়ার জন্য মেয়ের লাশটাও পাইনি। মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’
আলিনা নিখোঁজ হলে ১০ দিন পর্যন্ত মা–বাবা অপেক্ষায় ছিলেন, এই বোধ হয় মেয়ে ঘরে ফিরল। কিন্তু মা–বাবা এখন জেনে গেছেন তাদের কলিজার টুকরা মেয়েকে কয়েক টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মেয়েটির স্বজনেরা সাগরপাড়ে ছুটছেন, যদি তার শরীরের কোনো টুকরা, জামা, জুতা, হিজাব বা অন্য কিছু পাওয়া যায়, সে আশায়। আলিনার বাবা মো. সোহেল রানা মুঠোফোনে বললেন, ‘কলিজার শরীরের একটা টুকরাও যদি পাইতাম, দাফনটা তো করতে পারতাম। কলিজার তো কিছুই পাইলাম না।’
তিনি বললেন, সাগরপাড়ে গিয়ে তারা আলিনার যদি কোনো আলামত পাওয়া যায়, তাই খুঁজছেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘আমার মেয়েটা আমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে লুকোচুরি খেলত। ঘটনার দিনও দোকানে বসে তার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। মেয়েটা আচার খেতে চায়। মেয়ের তো আচার খাওয়া শেষ, আর খাবে না।’
শিশু আয়াত খুনের ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা প্রভাতী খবরকে মোবাইলে বলেন, সোমবার দুপুরে আসামী আবিরকে নিয়ে নিয়ে নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোড ও সাগরপাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বটি ও শিশুটির পায়ের স্যান্ডেলসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু, শিশুটির মরদেহের টুকরোর খোঁজ এখনো মেলেনি। পুলিশের ধারণা, মরদেহের টুকরোগুলো জোয়ার-ভাটায় সাগরে ভেসে গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরভাবে খুনের ঘটনা অনেক সময় বেড়ে যায়। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে; না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও অনেক সময় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে। লোভ-লালসা বা টাকার প্রয়োজনে মানুষ খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধও করে। সবার উচিত এদিকে দৃষ্টি দেয়া।