শিরোনামঃ
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে প্রবাসীর বাসা দখলের চেষ্টা , অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি ‘বাবা নেই’ ভিডিও গানের মোড়ক উন্মোচন আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষে থাকবে ইমপিরিয়াল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাতার মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশ জনতা পার্টির আলোচনা সভা রহিম আল-হুসাইনি আগা খান পঞ্চম-এর অভিষেক অনুষ্ঠিত আগা খান ৪র্থ আসওয়ান ,মিশরে শায়িত হলেন শিয়া ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম আগা খানের জানাজা অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাজারের ক্রয়কৃত দোকান দখল, থানায় অভিযোগ আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

... অতঃপর তুমি পেরেছ

#
news image

পথটা একেবারেই মসৃন ছিলনা। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে দেশের সবচেয়ে বড় ভৌত অবকাঠামো পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি এবং পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। আর তাইতো এর উদ্বোধন আজ বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায়। 


১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু উদ্বোধনকালে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সূত্রপাত মূলত এটাই এবং সেই সাথে বিপত্তির শুরুটাও সেখান থেকেই। 


পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদী শীর্ষে। দ্বিতীয় অবস্থানেই পদ্মা সেতু। তাই এরকম একটা খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ খুবই দুরুহ এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই সাথে বিশাল এই প্রকল্পে অর্থায়ন, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগিদের প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়া এবং সবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন, বারবার প্রকল্প ব্যায় বৃদ্ধি, দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র এবং করোনা মহামারীর ধাক্কা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজকে বারবারই ঠেলে দিচ্ছিল অনিশ্চয়তার দিকে কিংবা প্রলম্বিত করছিল এর বাস্তবায়নকে। কিন্তু হার না মানা এক দক্ষ দেশনায়ক, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সততা, সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও দুরদর্শীতায় সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাস্তবায়িত হল এই মহাপ্রকল্প। আজ হতে যাচ্ছে বহুল প্রতিক্ষীত এবং স্বপ্ন পূরনের এই সেতুর উদ্বোধন। 


প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। প্রমত্তা এই নদীর উত্তর পাড়ের জেলা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট, দক্ষিন পাড়ের শরীয়তপুর এবং মাদারীপুরের জাজিরা পয়েন্ট সংযুক্ত করেছে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু, যা দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করল। মাওয়া অংশে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা অংশে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার প্রকল্প এলাকা নিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হয়েছে চ্যালেঞ্জিং এ সেতু নির্মাণে। বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল পাইলিং নিয়েও। পাইলিং শুরুর পরে দেখা যায় পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। অর্থাৎ পদ্মার তলদেশের মাটি পাইলিং এর জন্য স্বাভাবিক নয়। ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক নদীর তলদেশে পাঠিয়ে স্ক্রিন গ্রাউটিং-এর মত বিরল পদ্ধতি অনুসরন করে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়, তারপর ওই মাটিতে পিলার গেঁথে দেওয়া হয়। 


এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। আর বর্তমান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু উদ্বোধনকালে পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন।  শুরু হয় এই সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই যা শেষ হয় ২০০১ সালে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ২০০৮ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ১৯ জুন সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। এরপর ২৯ জুন পরামর্শকের সঙ্গে চুক্তি হয়। পদ্মা সেতুর কাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার সময়ও নির্ধারণ করা হয় সে সময়। ২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। জাইকা, আইডিবি ও এডিবিও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখালে একই বছরের ১৮ মে জাইকা'র সাথে ৪০ কোটি ডলার, ২৪ মে  আইডিবি'র সাথে ১৪ কোটি ডলার এবং ৬ জুন এডিবি’র সাথে ৬২ কোটি ডলার ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। 


কিন্তু, এরই মধ্যে শুরু হয় যায় বিপত্তি। ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ মাসের মাথায় সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থছাড় স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও। ঋণচুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। 


চুক্তি বাতিল এড়াতে এসময় যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ কিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে তৎকালীন সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রীও পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। যদিও কানাডার আদালত পরবর্তিতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আনীত অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও মনগড়া হিসেবে আখ্যা দেয়।


ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং এসময় তিনি বাংলাদেশি ও প্রবাসীদের পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে এগিয়েও আসেন। 


বিশ্বব্যাংকের সাথে অর্থায়ন নিয়ে দেনদরবার চলাকালীন সময়ে গ্রামীন ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না পারা ড. মোঃ ইউনুছ সরকারকে চাপে ফেলতে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোনও করিয়েছিলেন বলে খবর রয়েছে। আর বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াত-এর বিভিন্ন নেতার এই সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে নানারকম অপপ্রচার ও নেতিবাচক মন্তব্য সামাল দিতে বা হজম করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে । 


২০০৭ সালে একনেক ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিক প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারো  ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।  পরবর্তিতে আরও ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা বাড়িয়ে সেতুর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটিতে। প্রকল্পের অনুমোদনের সময়ও ধরা ব্যয় জোগাড়েই দাতাদের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছিল দেশকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজ টাকায় এর তিনগুণ ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশ। 


এছাড়াও, বিভিন্ন প্রকার গুজবের আশ্রয় নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মানের কাজকে বন্ধ কিংবা বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছে অনেকে।  পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল ২০১৯ সালে। এরকম গুজবের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারী করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষকে একই সালের জুলাই মাসে। পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে জারী করা ঐ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি মহল সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি তুলে ধরে ঐ বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করা হয় যে ব্রিজ নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি গুজব।


করোনাভাইরাস মহামারীও সেতুর কাজ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়েছিল। সেতু নির্মাণে তিন শতাধিক চীনা নাগরিক জড়িত ছিল এবং যাদের অনেকে ছুটিতে ছিল। কিন্তু এই বাধার মধ্যেও বন্ধ থাকেনি সেতুর কাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করে গেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।

জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আত্মবিশ্বাস, সাহস ও সততা দিয়ে সব বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে জ্বালিয়েছেন আলো আর সর্বোপরি বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রমান দাড় করিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আর তাই বলতেই হয় ... অতঃপর তুমি পেরেছ!

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন

২৯ জুন, ২০২২,  12:39 AM

news image

পথটা একেবারেই মসৃন ছিলনা। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে দেশের সবচেয়ে বড় ভৌত অবকাঠামো পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি এবং পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। আর তাইতো এর উদ্বোধন আজ বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিয়ে যাবে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায়। 


১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু উদ্বোধনকালে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সূত্রপাত মূলত এটাই এবং সেই সাথে বিপত্তির শুরুটাও সেখান থেকেই। 


পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদী শীর্ষে। দ্বিতীয় অবস্থানেই পদ্মা সেতু। তাই এরকম একটা খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ খুবই দুরুহ এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই সাথে বিশাল এই প্রকল্পে অর্থায়ন, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগিদের প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়া এবং সবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন, বারবার প্রকল্প ব্যায় বৃদ্ধি, দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র এবং করোনা মহামারীর ধাক্কা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজকে বারবারই ঠেলে দিচ্ছিল অনিশ্চয়তার দিকে কিংবা প্রলম্বিত করছিল এর বাস্তবায়নকে। কিন্তু হার না মানা এক দক্ষ দেশনায়ক, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সততা, সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও দুরদর্শীতায় সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাস্তবায়িত হল এই মহাপ্রকল্প। আজ হতে যাচ্ছে বহুল প্রতিক্ষীত এবং স্বপ্ন পূরনের এই সেতুর উদ্বোধন। 


প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। প্রমত্তা এই নদীর উত্তর পাড়ের জেলা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট, দক্ষিন পাড়ের শরীয়তপুর এবং মাদারীপুরের জাজিরা পয়েন্ট সংযুক্ত করেছে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু, যা দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করল। মাওয়া অংশে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা অংশে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার প্রকল্প এলাকা নিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হয়েছে চ্যালেঞ্জিং এ সেতু নির্মাণে। বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল পাইলিং নিয়েও। পাইলিং শুরুর পরে দেখা যায় পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। অর্থাৎ পদ্মার তলদেশের মাটি পাইলিং এর জন্য স্বাভাবিক নয়। ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক নদীর তলদেশে পাঠিয়ে স্ক্রিন গ্রাউটিং-এর মত বিরল পদ্ধতি অনুসরন করে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়, তারপর ওই মাটিতে পিলার গেঁথে দেওয়া হয়। 


এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। আর বর্তমান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু উদ্বোধনকালে পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন।  শুরু হয় এই সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই যা শেষ হয় ২০০১ সালে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ২০০৮ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ১৯ জুন সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। এরপর ২৯ জুন পরামর্শকের সঙ্গে চুক্তি হয়। পদ্মা সেতুর কাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার সময়ও নির্ধারণ করা হয় সে সময়। ২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। জাইকা, আইডিবি ও এডিবিও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখালে একই বছরের ১৮ মে জাইকা'র সাথে ৪০ কোটি ডলার, ২৪ মে  আইডিবি'র সাথে ১৪ কোটি ডলার এবং ৬ জুন এডিবি’র সাথে ৬২ কোটি ডলার ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। 


কিন্তু, এরই মধ্যে শুরু হয় যায় বিপত্তি। ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ মাসের মাথায় সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থছাড় স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও। ঋণচুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। 


চুক্তি বাতিল এড়াতে এসময় যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ কিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে তৎকালীন সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রীও পদত্যাগ করেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। যদিও কানাডার আদালত পরবর্তিতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আনীত অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও মনগড়া হিসেবে আখ্যা দেয়।


ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং এসময় তিনি বাংলাদেশি ও প্রবাসীদের পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে এগিয়েও আসেন। 


বিশ্বব্যাংকের সাথে অর্থায়ন নিয়ে দেনদরবার চলাকালীন সময়ে গ্রামীন ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না পারা ড. মোঃ ইউনুছ সরকারকে চাপে ফেলতে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোনও করিয়েছিলেন বলে খবর রয়েছে। আর বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াত-এর বিভিন্ন নেতার এই সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে নানারকম অপপ্রচার ও নেতিবাচক মন্তব্য সামাল দিতে বা হজম করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে । 


২০০৭ সালে একনেক ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিক প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারো  ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।  পরবর্তিতে আরও ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা বাড়িয়ে সেতুর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটিতে। প্রকল্পের অনুমোদনের সময়ও ধরা ব্যয় জোগাড়েই দাতাদের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছিল দেশকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজ টাকায় এর তিনগুণ ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশ। 


এছাড়াও, বিভিন্ন প্রকার গুজবের আশ্রয় নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মানের কাজকে বন্ধ কিংবা বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছে অনেকে।  পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল ২০১৯ সালে। এরকম গুজবের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারী করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষকে একই সালের জুলাই মাসে। পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে জারী করা ঐ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি মহল সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি তুলে ধরে ঐ বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করা হয় যে ব্রিজ নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি গুজব।


করোনাভাইরাস মহামারীও সেতুর কাজ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়েছিল। সেতু নির্মাণে তিন শতাধিক চীনা নাগরিক জড়িত ছিল এবং যাদের অনেকে ছুটিতে ছিল। কিন্তু এই বাধার মধ্যেও বন্ধ থাকেনি সেতুর কাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করে গেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।

জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আত্মবিশ্বাস, সাহস ও সততা দিয়ে সব বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে জ্বালিয়েছেন আলো আর সর্বোপরি বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রমান দাড় করিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আর তাই বলতেই হয় ... অতঃপর তুমি পেরেছ!