শিরোনামঃ
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে প্রবাসীর বাসা দখলের চেষ্টা , অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি ‘বাবা নেই’ ভিডিও গানের মোড়ক উন্মোচন আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষে থাকবে ইমপিরিয়াল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাতার মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশ জনতা পার্টির আলোচনা সভা রহিম আল-হুসাইনি আগা খান পঞ্চম-এর অভিষেক অনুষ্ঠিত আগা খান ৪র্থ আসওয়ান ,মিশরে শায়িত হলেন শিয়া ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম আগা খানের জানাজা অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাজারের ক্রয়কৃত দোকান দখল, থানায় অভিযোগ আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে কাগজের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানুন

#
news image

বছরের শেষের দিকে যখন প্রকাশকরা বইমেলার প্রস্তুতি নেবে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডায়েরি, ক্যালেন্ডার তৈরি করবে। স্কুলগুলোতে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণের উদ্দেশ্যে বই মুদ্রণ করবে এমন এক মুহূর্তে কাগজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে কাগজের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে- যা প্রকাশনা শিল্প তথা মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- যা অতীব দুঃখজনক। বর্তমানে এই কাগজের দাম বাড়তে থাকায় তৈরি পণ্যে গত এক সপ্তাহে ৩০ শতাংশের মতো দাম বাড়ছে, ফলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা'র মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যা সত্যিকারে মেনে নেওয়া কঠিন। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে- ফলে এ সুযোগে হুহু করে বাড়ছে খোলা ও পাইকারি বাজারে কাগজের দাম। তবে সব ধরনের কাগজের দাম একই হারে বাড়েনি। কাগজের নানা পদের মধ্যে টন প্রতি সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বহন করা সবার জন্যই কষ্টসাধ্য। তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে।

হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টন প্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতিটন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। মূলত গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। কম দামি এ কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা অনেকই বলছেন, মিল থেকে কাগজ মিলছে কম। এদিকে হুট করে দামটা বেশি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের কাছেও তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ফলে তারা কাগজ কিনছেন কম। ফলে তাদের বেচাকেনাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এহেন পরিস্থিতির জন্য অনেকেই জ¦ালানিসংকটকে দায়ী করছেন। বর্তমানে দেশে জ¦ালানি সংকটের কারণে বর্তমানে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে রেশনিং করে নিত্যপণ্যের মিলগুলো চালুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে করে অন্য মিলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর বিশেষ প্রভাব পড়ছে কাগজের মিলগুলোতে। ফলে উৎপাদন কম হওয়ায় কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে ফলে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

দৃশ্যমান পাইকারি বাজারে শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজের দামও। তথ্য মতে গত এক সপ্তাহে প্রতি ১০০টি মলাটের কাগজের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। একই পরিমাণ আর্ট কার্ডের দামও এখন ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ১০০টি আর্ট কার্ড মিলছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। এক রিম রঙিন কাগজের দাম ৮৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে কলম তৈরির পস্নাস্টিকের প্রতি ২৫ কেজি বস্তার দাম ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে। কাগজসংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপকরণের দামও বাড়তি। পাইকারিতে এক সপ্তাহ আগে ১২০ পৃষ্ঠার এক ডজন খাতা বিক্রি হয়েছিল ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। এখন তা ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাজারে এই কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়েরি, নোটবুক, বিভিন্ন ফাইলপত্র, লেজার খাতা, বক্স ফাইল, খাতার মতো কাগজের উপকরণের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। মাঝারি আকারের ১০০টি খাকি খামের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার স্বাভাবিক থাকলে এ সময়ে কাজের অভাব হয় না। কিন্তু কাগজের দাম বাড়তে থাকায় কাজ কমতে শুরু করেছে। অনেক গ্রাহক ইতোমধ্যে ই-মেইল ও মুঠোফোনে জানিয়েছে, নতুন করে কাগজের দাম সমন্বয় ছাড়া তারা মুদ্রণ কাজ বন্ধ রাখতে বলছেন। যা দেশের মুদ্রণ শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করি। দ্রম্নত এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করি।

অপর দিকে কাগজের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের সংবাদপত্র। কারণ আকস্মিকভাবেই মাত্রাতিরিক্ত দাম বেড়েছে কাগজের। প্রতি টনে কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের খাতা হিসেবে যেমন কাগজের ব্যবহার রয়েছে তেমনই আবার বই ও সংবাদপত্র ছাপতেও প্রয়োজন কাগজের। কিন্তু এসবের অন্যতম এই উপকরণের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। মাত্র পাঁচ মাসেই পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। এতে বিপাকে পড়েছে সংবাদপত্রের মালিক, শিক্ষার্থী ও প্রকাশনা শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এর মধ্যে চলমান ৭০ থেকে ৭৫টি। বাকি মিল নানা সংকটের কারণে এখন আর উৎপাদনে নেই। দুই দশক আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাতের মিল মালিকরা একচেটিয়া বাণিজ্য করার সুযোগ নিচ্ছেন। নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ানো হচ্ছে কাগজের দাম। অন্যদিকে এতে দৃষ্টি দেওয়ারও কেউ নেই। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ।

কাগজ সংকটের কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় শিল্প বিকাশে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। তবে নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত পাল্প দেশীয় পুরোনো কাগজ রিসাইক্লিন করে পাওয়া গেলেও সাদা কাগজ উৎপাদনে পাল্প আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে পাল্প আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যেসব মিলের প্রতিদিন ৫০০ টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো এখন ৭০ থেকে ৮০ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে কাগজের দাম অনেক বেড়েছে। প্রত্যেক সপ্তাহে দাম বাড়ে। যে খাতা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কেনা যেত তা এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ২৮০ টাকার রিম এখন প্রায় ৪০০ টাকা। রাজধানীর চকবাজারের পুস্তক প্রকাশক মিয়া রিয়াজুল ইসলাম বলেন, 'কাগজের দাম টনপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আগে কাগজের মূল্য ছিল ৯৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। নিউজপ্রিন্ট কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়। যা কয়েক মাস আগেও কিনেছি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়। তবে, বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে।

এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। মুদ্রাকররা জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিক স্তরের চার রংয়ের বই ছাপা হয় ৮০ জিএসএম কাগজে। আর মাধ্যমিকের এক রংয়ের বই ছাপানো হয় ৬০ জিএসএম কাগজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন বাজারে এ মানের কাগজের দর ছিল প্রতি টনে ৫০ হাজার টাকা। এখন দাম বেড়েছে প্রায় দেড় থেকে দ্বিগুণ। দরবৃদ্ধির কারণে বেঁকে বসেছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাজারে চলমান দাম অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হবে- তা না হলে তারা বই ছাপাতে পারবেন না। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে এক লাখ টনেরও বেশি কাগজ। এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া। অন্যদিকে ফেব্রম্নয়ারির একুশে বইমেলা সামনে রেখে উদ্বেগ বাড়ছে প্রকাশকদের মধ্যে।

এ অবস্থায় কাগজের আমদানি, দেশীয় উৎপাদন ও সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং এ খাত নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের প্রকাশনা শিল্প তথা সংবাদপত্রগুলোকে বাঁচাতে দ্রম্নত কাগজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, বন্ধ মিলগুলোকে চালুর ব্যবস্থাসহ সঠিক সরবরাহ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা একান্ত কাম্য। 

লেখক: সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি

মো. আতিকুর রহমান

২৪ নভেম্বর, ২০২২,  12:22 AM

news image

বছরের শেষের দিকে যখন প্রকাশকরা বইমেলার প্রস্তুতি নেবে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডায়েরি, ক্যালেন্ডার তৈরি করবে। স্কুলগুলোতে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণের উদ্দেশ্যে বই মুদ্রণ করবে এমন এক মুহূর্তে কাগজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে কাগজের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে- যা প্রকাশনা শিল্প তথা মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- যা অতীব দুঃখজনক। বর্তমানে এই কাগজের দাম বাড়তে থাকায় তৈরি পণ্যে গত এক সপ্তাহে ৩০ শতাংশের মতো দাম বাড়ছে, ফলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা'র মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যা সত্যিকারে মেনে নেওয়া কঠিন। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে- ফলে এ সুযোগে হুহু করে বাড়ছে খোলা ও পাইকারি বাজারে কাগজের দাম। তবে সব ধরনের কাগজের দাম একই হারে বাড়েনি। কাগজের নানা পদের মধ্যে টন প্রতি সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বহন করা সবার জন্যই কষ্টসাধ্য। তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে।

হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টন প্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতিটন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। মূলত গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। কম দামি এ কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা অনেকই বলছেন, মিল থেকে কাগজ মিলছে কম। এদিকে হুট করে দামটা বেশি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের কাছেও তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ফলে তারা কাগজ কিনছেন কম। ফলে তাদের বেচাকেনাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এহেন পরিস্থিতির জন্য অনেকেই জ¦ালানিসংকটকে দায়ী করছেন। বর্তমানে দেশে জ¦ালানি সংকটের কারণে বর্তমানে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে রেশনিং করে নিত্যপণ্যের মিলগুলো চালুতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে করে অন্য মিলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর বিশেষ প্রভাব পড়ছে কাগজের মিলগুলোতে। ফলে উৎপাদন কম হওয়ায় কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে ফলে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

দৃশ্যমান পাইকারি বাজারে শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজের দামও। তথ্য মতে গত এক সপ্তাহে প্রতি ১০০টি মলাটের কাগজের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। একই পরিমাণ আর্ট কার্ডের দামও এখন ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ১০০টি আর্ট কার্ড মিলছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। এক রিম রঙিন কাগজের দাম ৮৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে কলম তৈরির পস্নাস্টিকের প্রতি ২৫ কেজি বস্তার দাম ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে। কাগজসংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপকরণের দামও বাড়তি। পাইকারিতে এক সপ্তাহ আগে ১২০ পৃষ্ঠার এক ডজন খাতা বিক্রি হয়েছিল ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। এখন তা ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাজারে এই কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়েরি, নোটবুক, বিভিন্ন ফাইলপত্র, লেজার খাতা, বক্স ফাইল, খাতার মতো কাগজের উপকরণের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। মাঝারি আকারের ১০০টি খাকি খামের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার স্বাভাবিক থাকলে এ সময়ে কাজের অভাব হয় না। কিন্তু কাগজের দাম বাড়তে থাকায় কাজ কমতে শুরু করেছে। অনেক গ্রাহক ইতোমধ্যে ই-মেইল ও মুঠোফোনে জানিয়েছে, নতুন করে কাগজের দাম সমন্বয় ছাড়া তারা মুদ্রণ কাজ বন্ধ রাখতে বলছেন। যা দেশের মুদ্রণ শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করি। দ্রম্নত এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করি।

অপর দিকে কাগজের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের সংবাদপত্র। কারণ আকস্মিকভাবেই মাত্রাতিরিক্ত দাম বেড়েছে কাগজের। প্রতি টনে কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের খাতা হিসেবে যেমন কাগজের ব্যবহার রয়েছে তেমনই আবার বই ও সংবাদপত্র ছাপতেও প্রয়োজন কাগজের। কিন্তু এসবের অন্যতম এই উপকরণের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। মাত্র পাঁচ মাসেই পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। এতে বিপাকে পড়েছে সংবাদপত্রের মালিক, শিক্ষার্থী ও প্রকাশনা শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এর মধ্যে চলমান ৭০ থেকে ৭৫টি। বাকি মিল নানা সংকটের কারণে এখন আর উৎপাদনে নেই। দুই দশক আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাতের মিল মালিকরা একচেটিয়া বাণিজ্য করার সুযোগ নিচ্ছেন। নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ানো হচ্ছে কাগজের দাম। অন্যদিকে এতে দৃষ্টি দেওয়ারও কেউ নেই। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ।

কাগজ সংকটের কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় শিল্প বিকাশে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। তবে নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত পাল্প দেশীয় পুরোনো কাগজ রিসাইক্লিন করে পাওয়া গেলেও সাদা কাগজ উৎপাদনে পাল্প আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে পাল্প আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যেসব মিলের প্রতিদিন ৫০০ টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো এখন ৭০ থেকে ৮০ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাসে কাগজের দাম অনেক বেড়েছে। প্রত্যেক সপ্তাহে দাম বাড়ে। যে খাতা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কেনা যেত তা এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ২৮০ টাকার রিম এখন প্রায় ৪০০ টাকা। রাজধানীর চকবাজারের পুস্তক প্রকাশক মিয়া রিয়াজুল ইসলাম বলেন, 'কাগজের দাম টনপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আগে কাগজের মূল্য ছিল ৯৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। নিউজপ্রিন্ট কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়। যা কয়েক মাস আগেও কিনেছি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়। তবে, বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে।

এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। মুদ্রাকররা জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিক স্তরের চার রংয়ের বই ছাপা হয় ৮০ জিএসএম কাগজে। আর মাধ্যমিকের এক রংয়ের বই ছাপানো হয় ৬০ জিএসএম কাগজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন বাজারে এ মানের কাগজের দর ছিল প্রতি টনে ৫০ হাজার টাকা। এখন দাম বেড়েছে প্রায় দেড় থেকে দ্বিগুণ। দরবৃদ্ধির কারণে বেঁকে বসেছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাজারে চলমান দাম অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হবে- তা না হলে তারা বই ছাপাতে পারবেন না। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে এক লাখ টনেরও বেশি কাগজ। এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া। অন্যদিকে ফেব্রম্নয়ারির একুশে বইমেলা সামনে রেখে উদ্বেগ বাড়ছে প্রকাশকদের মধ্যে।

এ অবস্থায় কাগজের আমদানি, দেশীয় উৎপাদন ও সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং এ খাত নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের প্রকাশনা শিল্প তথা সংবাদপত্রগুলোকে বাঁচাতে দ্রম্নত কাগজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, বন্ধ মিলগুলোকে চালুর ব্যবস্থাসহ সঠিক সরবরাহ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা একান্ত কাম্য। 

লেখক: সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি