শিরোনামঃ
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে প্রবাসীর বাসা দখলের চেষ্টা , অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি ‘বাবা নেই’ ভিডিও গানের মোড়ক উন্মোচন আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষে থাকবে ইমপিরিয়াল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাতার মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশ জনতা পার্টির আলোচনা সভা রহিম আল-হুসাইনি আগা খান পঞ্চম-এর অভিষেক অনুষ্ঠিত আগা খান ৪র্থ আসওয়ান ,মিশরে শায়িত হলেন শিয়া ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম আগা খানের জানাজা অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাজারের ক্রয়কৃত দোকান দখল, থানায় অভিযোগ আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

চা বাগান ছেড়ে কোথাও যাওয়ার নেই 

#
news image

টানা কয়েকদিনের আন্দোলনের পর চা শ্রমিকরা কাজে যোগদার করলেন। তবে তাদের দাবি পুরোপুরি পূরণ হয়নি। কিন্তু তারা অসহায়। কাজ না করলে পেট চলবে না। তাই সব দাবি পূরণ না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সম্মান রেখেই তারা কাজে ফিরেছেন। দেশে এ ধরনের আন্দোলন বহু হতে দেখিনি। ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের ৬ লাখের বেশি সদস্য ১৭ দিন ধরে আন্দোলন করেছেন। বিছিন্নপ্রান্তে পড়ে থাকা একদল শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। দিনে ১২০ টাকা নগদ মজুরি আর সপ্তাহে রেশন, জীর্ণ ঘরে বংশ পরম্পরায় গাদাগাদি করে বসবাস করা চা শ্রমিকদের আন্দোলন চলে ৭ আগস্ট থেকে। প্রথমে প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি, এরপর লাগাতার ধর্মঘট। ১৩ আগস্ট থেকে চলেছে এই পূর্ণ ধর্মঘট। এর অবসান হলো ২৭ আগস্ট।
চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মালিকপক্ষের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিচারে ৩০০ টাকা মজুরির দাবি ন্যায্যই ছিল। 
হাজারো নারী শ্রমিক কমপক্ষে ২৩ কেজি পাতা তুলে বড় পোঁটলা বানিয়ে মাথায় করে নিয়ে যান ওজন করার স্থানে। ছায়া বৃক্ষের ছায়া তাদের রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচাতে পারে না। তাই রোদে পোড়া গায়ের রঙ তাদের। সারাদিন প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য তাদের কোনো শৌচাগার নেই। মুখ বুঝে সব সহ্য করা এই নারীরা কেন বাগানের কাজ আর ঘরের দায়িত্ব ছেড়ে রাস্তায়, তা বুঝল অনেক দেরিতে মালিকপক্ষ ও সরকার! যখন তারা পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলেÑ আমরা কি বেঁচে আছি যে, আমাদের মারবেন? তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কতখানি যন্ত্রণা তাদের বুকে। 
মালিকরা জানান, বস্তুত চা শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দৈনিক প্রায় ৪২২ টাকা পেয়ে থাকেন। মালিকদের হিসাবে শ্রমিকরা মাসে প্রায় ১১ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি চাপাতা তুলে তারা দৈনিক ৬৫ টাকা প্লাকিং বোনাস পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া ছুটির দিন কাজ করে এবং ভোরে মর্নিং ক্যাশ প্লাক করে তারা অতিরিক্ত আয় করে থাকেন। 
টি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী চাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন। এই শিল্পে প্রত্যেক শ্রমিককে ২ টাকা কেজিদরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল বা আটা রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১০ টাকা। তা ছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় করতে চাশিল্পে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের বসতবাড়ির জন্য বিনামূল্যে পরিবারপ্রতি ১ হাজার ৫৫১ বর্গফুট জায়গার মধ্যে ৩৭০ বর্গফুটের সর্বমোট ৬৮ হাজার ৮০৬ বসতবাড়ি কোম্পানি নির্মাণ করেছে। শ্রমিকের ভাতা, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভূতি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। 
বাংলাদেশি চা সংসদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মজুরি হিসাবে নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে দৈনিক ঘরভাড়া বাবদ ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা, চিকিৎসা বাবদ সাড়ে ৭ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ শূন্য দশমিক শূন্য ২ টাকা, বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা, অবসরভাতা ২ টাকা, গরু চরানো বাবদ ১ টাকা, চা শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয় বাবদ দেড় টাকা দেওয়া হয়। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অতিরিক্ত সময়ে বা অধিক কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি প্রদানের কথা আছে। তা দেওয়া হয় না? তাই এগুলোকে দৈনিক হিসাবে দেখানো নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক। এ ছাড়া রেশনের হিসাবও ঠিক নেই। একজন স্থায়ী পুরুষ শ্রমিক সপ্তাহে রেশন পান ৩ দশমিক ২৭ কেজি। তার নির্ভরশীল স্ত্রী পান ২ দশমিক ৪৪ কেজি, সন্তান (৮ বছর পর্যন্ত) ১ দশমিক ২২ কেজি, সন্তান (১২ বছরের নিচে) ২ দশমিক ৪৪ কেজি চাল অথবা আটা পেয়ে থাকেন। সন্তানের বয়স ১২ বছরের বেশি হলে মা-বাবা তাদের জন্য কোনো রেশন পাবেন না। চা বাগানের বেশিরভাগ শ্রমিক নারী। কিন্তু তারা তাদের নির্ভরশীলদের জন্য কোনো রেশন পান না। তিনি অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। 
ধানিজমি থাকলে রেশন দেওয়া হয় না। দেখা যাচ্ছে রেশনের হিসাব বেশ জটিল। সপ্তাহে রেশন পান ৬ কেজি থেকে ৯ দশমিক ৩৭ কেজি আর মাসে সর্বমোট রেশন পেয়ে থাকেন ২৪ কেজি থেকে ৩৭.৪৮ কেজি। কেজি প্রতি দাম শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২ টাকা। কেজি প্রতি ৪৫ টাকা ভর্তুকি দিলে মাসে রেশন বাবদ শ্রমিকরা পান ১০৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬৮৬ টাকা। তাহলে দিনে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা থেকে ৫৬ টাকা। প্রচার আর প্রাপ্তির মধ্যে কি বিশাল ঘাটতি।
মালিকদের দাবি, চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সবাই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধু শ্রমিক নিজেই এ সুবিধা পান। শ্রমিকদের মৃত্যুর পরও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চাশিল্পে ২টি বড় আকারের আধুনিক গ্রুপ হাসপাতাল ও ৮৪টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫টি ডিসপেনসারিসহ সর্বমোট ৮৯১ মেডিক্যাল স্টাফ নিয়োজিত আছেন। টি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলেন, চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চবিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ১ হাজার ২৩২ শিক্ষক কর্মরত আছেন এবং বর্তমানে ৪৪ হাজার ১৭১ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। 
১৬৮টি বাগানে ৭৬৮টি বিদ্যালয় হলে গড়ে প্রতি বাগানে সাড়ে ৪টি বিদ্যালয়। কিন্তু একটা হিসাব সব গোলমাল করে দিল। শিক্ষক আছেন ১ হাজার ২৩২ জন। মানে বাগান প্রতি দেড়জন শিক্ষক। একটি স্কুলে এক-দুই শিক্ষক কি শিক্ষা দিতো পারেন? শ্রম আইনের বিধিমালা অনুযায়ী বাগান মালিকের নিজ উদ্যোগে বাগানপ্রতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ বাগান মালিক তা নির্মাণ করেননি। 
অনেকের অভিমত, এত যদি বঞ্চনা থাকলে চা শ্রমিকরা অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিলেই তো পারেন? তারা চা শ্রমিকদের জীবন ও সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, আত্মীয়তার বন্ধন এবং শত বছর ধরে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রভাব বিবেচনা করেননি। আসলে চা বাগান ছেড়ে তাদের কোথাও যাওয়ার নেই। তা ছাড়া বৃহত্তর সমাজ তাদের গ্রহণও করবে না। এ চিন্তা তাদের মাটি কামড়ে বাগানেই পড়ে থাকতে বাধ্য করে। মালিকরা যথার্থই বলেছেন, চা শ্রমিকরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চা বাগানেই জড়িয়ে থাকেন। এটিই চা শ্রমিকদের অসহায়ত্ব আর বাগান মালিকদের শক্তি। 
পরিশেষে বলব, চা শ্রমিকদের এই আন্দোলন জানান দিয়েছে তাদের জীবনের বঞ্চনা। তারা আন্দোলন না করলে হয়তো কোনোদিনই জানা হতো তাদের কষ্টের জীবনধারা। তাই চা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনের উপযোগী মজুরি নির্ধারণে মালিকপক্ষ আরও সদয় হবে বলে সবার বিশ্বাস। এ ছাড়া সবাইকে শ্রমিকদের পাশেই থাকতে হবে।

খান অপূর্ব আহমদ

২৯ আগস্ট, ২০২২,  10:06 PM

news image

টানা কয়েকদিনের আন্দোলনের পর চা শ্রমিকরা কাজে যোগদার করলেন। তবে তাদের দাবি পুরোপুরি পূরণ হয়নি। কিন্তু তারা অসহায়। কাজ না করলে পেট চলবে না। তাই সব দাবি পূরণ না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সম্মান রেখেই তারা কাজে ফিরেছেন। দেশে এ ধরনের আন্দোলন বহু হতে দেখিনি। ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের ৬ লাখের বেশি সদস্য ১৭ দিন ধরে আন্দোলন করেছেন। বিছিন্নপ্রান্তে পড়ে থাকা একদল শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। দিনে ১২০ টাকা নগদ মজুরি আর সপ্তাহে রেশন, জীর্ণ ঘরে বংশ পরম্পরায় গাদাগাদি করে বসবাস করা চা শ্রমিকদের আন্দোলন চলে ৭ আগস্ট থেকে। প্রথমে প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি, এরপর লাগাতার ধর্মঘট। ১৩ আগস্ট থেকে চলেছে এই পূর্ণ ধর্মঘট। এর অবসান হলো ২৭ আগস্ট।
চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মালিকপক্ষের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিচারে ৩০০ টাকা মজুরির দাবি ন্যায্যই ছিল। 
হাজারো নারী শ্রমিক কমপক্ষে ২৩ কেজি পাতা তুলে বড় পোঁটলা বানিয়ে মাথায় করে নিয়ে যান ওজন করার স্থানে। ছায়া বৃক্ষের ছায়া তাদের রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচাতে পারে না। তাই রোদে পোড়া গায়ের রঙ তাদের। সারাদিন প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য তাদের কোনো শৌচাগার নেই। মুখ বুঝে সব সহ্য করা এই নারীরা কেন বাগানের কাজ আর ঘরের দায়িত্ব ছেড়ে রাস্তায়, তা বুঝল অনেক দেরিতে মালিকপক্ষ ও সরকার! যখন তারা পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলেÑ আমরা কি বেঁচে আছি যে, আমাদের মারবেন? তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কতখানি যন্ত্রণা তাদের বুকে। 
মালিকরা জানান, বস্তুত চা শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দৈনিক প্রায় ৪২২ টাকা পেয়ে থাকেন। মালিকদের হিসাবে শ্রমিকরা মাসে প্রায় ১১ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি চাপাতা তুলে তারা দৈনিক ৬৫ টাকা প্লাকিং বোনাস পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া ছুটির দিন কাজ করে এবং ভোরে মর্নিং ক্যাশ প্লাক করে তারা অতিরিক্ত আয় করে থাকেন। 
টি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী চাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন। এই শিল্পে প্রত্যেক শ্রমিককে ২ টাকা কেজিদরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল বা আটা রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১০ টাকা। তা ছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় করতে চাশিল্পে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের বসতবাড়ির জন্য বিনামূল্যে পরিবারপ্রতি ১ হাজার ৫৫১ বর্গফুট জায়গার মধ্যে ৩৭০ বর্গফুটের সর্বমোট ৬৮ হাজার ৮০৬ বসতবাড়ি কোম্পানি নির্মাণ করেছে। শ্রমিকের ভাতা, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভূতি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। 
বাংলাদেশি চা সংসদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মজুরি হিসাবে নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে দৈনিক ঘরভাড়া বাবদ ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা, চিকিৎসা বাবদ সাড়ে ৭ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ শূন্য দশমিক শূন্য ২ টাকা, বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা, অবসরভাতা ২ টাকা, গরু চরানো বাবদ ১ টাকা, চা শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয় বাবদ দেড় টাকা দেওয়া হয়। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অতিরিক্ত সময়ে বা অধিক কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি প্রদানের কথা আছে। তা দেওয়া হয় না? তাই এগুলোকে দৈনিক হিসাবে দেখানো নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক। এ ছাড়া রেশনের হিসাবও ঠিক নেই। একজন স্থায়ী পুরুষ শ্রমিক সপ্তাহে রেশন পান ৩ দশমিক ২৭ কেজি। তার নির্ভরশীল স্ত্রী পান ২ দশমিক ৪৪ কেজি, সন্তান (৮ বছর পর্যন্ত) ১ দশমিক ২২ কেজি, সন্তান (১২ বছরের নিচে) ২ দশমিক ৪৪ কেজি চাল অথবা আটা পেয়ে থাকেন। সন্তানের বয়স ১২ বছরের বেশি হলে মা-বাবা তাদের জন্য কোনো রেশন পাবেন না। চা বাগানের বেশিরভাগ শ্রমিক নারী। কিন্তু তারা তাদের নির্ভরশীলদের জন্য কোনো রেশন পান না। তিনি অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। 
ধানিজমি থাকলে রেশন দেওয়া হয় না। দেখা যাচ্ছে রেশনের হিসাব বেশ জটিল। সপ্তাহে রেশন পান ৬ কেজি থেকে ৯ দশমিক ৩৭ কেজি আর মাসে সর্বমোট রেশন পেয়ে থাকেন ২৪ কেজি থেকে ৩৭.৪৮ কেজি। কেজি প্রতি দাম শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২ টাকা। কেজি প্রতি ৪৫ টাকা ভর্তুকি দিলে মাসে রেশন বাবদ শ্রমিকরা পান ১০৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬৮৬ টাকা। তাহলে দিনে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা থেকে ৫৬ টাকা। প্রচার আর প্রাপ্তির মধ্যে কি বিশাল ঘাটতি।
মালিকদের দাবি, চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সবাই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধু শ্রমিক নিজেই এ সুবিধা পান। শ্রমিকদের মৃত্যুর পরও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চাশিল্পে ২টি বড় আকারের আধুনিক গ্রুপ হাসপাতাল ও ৮৪টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫টি ডিসপেনসারিসহ সর্বমোট ৮৯১ মেডিক্যাল স্টাফ নিয়োজিত আছেন। টি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলেন, চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চবিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ১ হাজার ২৩২ শিক্ষক কর্মরত আছেন এবং বর্তমানে ৪৪ হাজার ১৭১ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। 
১৬৮টি বাগানে ৭৬৮টি বিদ্যালয় হলে গড়ে প্রতি বাগানে সাড়ে ৪টি বিদ্যালয়। কিন্তু একটা হিসাব সব গোলমাল করে দিল। শিক্ষক আছেন ১ হাজার ২৩২ জন। মানে বাগান প্রতি দেড়জন শিক্ষক। একটি স্কুলে এক-দুই শিক্ষক কি শিক্ষা দিতো পারেন? শ্রম আইনের বিধিমালা অনুযায়ী বাগান মালিকের নিজ উদ্যোগে বাগানপ্রতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ বাগান মালিক তা নির্মাণ করেননি। 
অনেকের অভিমত, এত যদি বঞ্চনা থাকলে চা শ্রমিকরা অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিলেই তো পারেন? তারা চা শ্রমিকদের জীবন ও সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, আত্মীয়তার বন্ধন এবং শত বছর ধরে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রভাব বিবেচনা করেননি। আসলে চা বাগান ছেড়ে তাদের কোথাও যাওয়ার নেই। তা ছাড়া বৃহত্তর সমাজ তাদের গ্রহণও করবে না। এ চিন্তা তাদের মাটি কামড়ে বাগানেই পড়ে থাকতে বাধ্য করে। মালিকরা যথার্থই বলেছেন, চা শ্রমিকরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চা বাগানেই জড়িয়ে থাকেন। এটিই চা শ্রমিকদের অসহায়ত্ব আর বাগান মালিকদের শক্তি। 
পরিশেষে বলব, চা শ্রমিকদের এই আন্দোলন জানান দিয়েছে তাদের জীবনের বঞ্চনা। তারা আন্দোলন না করলে হয়তো কোনোদিনই জানা হতো তাদের কষ্টের জীবনধারা। তাই চা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবনের উপযোগী মজুরি নির্ধারণে মালিকপক্ষ আরও সদয় হবে বলে সবার বিশ্বাস। এ ছাড়া সবাইকে শ্রমিকদের পাশেই থাকতে হবে।