অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা প্রয়োজন

রেজাউল করিম খোকন
৩১ আগস্ট, ২০২২, 12:20 AM

অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা প্রয়োজন
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। কারও জন্য তা আতঙ্কের। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থাকলে অর্থনীতির দুর্বলতা আরও ঘনীভূত হয়, সবল দিকগুলো দুর্বল হতে থাকে। অর্থনীতির নীতি বাস্তবায়ন অনেকটাই আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। তাই আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাই অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম।
মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে ব্যবসা খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় বাড়াতে নানা উদ্ভাবনী ও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমানে আমরা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কেউ কেউ মনে করেন, বৈদেশিক চাপের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটজনক পরিস্থিতি আমাদের চাপে ফেলেছে। কর-জিডিপি অনুপাত এখন মাত্র ৯ শতাংশের মতো। এটি যদি ১৪-১৫ শতাংশ হতো, তাহলে সরকারের আরও বেশি খরচ করার সামর্থ্য থাকত, যা অর্থনীতিকে এক ধরনের স্বস্তি দিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পারছে না। ভর্তুকি দিতে পারছে না। এতদিন ধরে যে উন্নয়ন আলেখ্য রচনা করা হয়েছে, তাতে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বেশি বিনিয়োগ করা হয়নি। ফলে এখন যে উৎপাদনশীল দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার ছিল, তা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের বর্তমান উন্নয়ন নীতিতে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য আছে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতায় তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। এই এগুলো হলো, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা; উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে সমর্থন দেওয়া; বিপন্ন মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এই নীতি সমঝোতা প্রণয়ন ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। এই নীতি সমঝোতা করতে সরকারকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। যেমন, মন্ত্রিপরিষদ; আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কমিটি; অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি-এসব জায়গায় আলোচনা হতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে সরকারের নিজেদের রাজনৈতিক সহযোগী; এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শ্রেণি-পেশার সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা দরকার। সরকারের নীতি প্রণয়নে এক ধরনের স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব আছে। বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে দুই-তিন বছরের জন্য ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা হলে দুই ধরনের উপকার হবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার কাছে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দর কষাকষি সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তাপপূর্ণ কর্মকান্ডের সময়ে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট এই নীতি সমঝোতা অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেবে।
সরকার অবশ্য কিছুকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি ব্যয় সাশ্রয়, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি আনা। এসব পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ, অপর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিকতা নেই। এতদিন অর্থনীতির এই সমস্যাগুলো অস্বীকারের প্রবণতা ছিল। এখন চাপে পড়ে সামান্য স্বীকার করা হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া বিপন্ন মানুষই দুর্দশার সবচেয়ে বড় ভাগিদার। এ মুহূর্তে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান রক্ষা করা বড় অর্থনৈতিক দায়িত্ব। সরকারের ঘোষিত 'ফ্যামিলি কার্ড' ব্যবস্থাকে দ্রম্নততার সঙ্গে ও দুর্নীতিমুক্তভাবে চালু করা দরকার। টিসিবির মাধ্যমে চালসহ অন্য নিত্যপণ্য জেলা পর্যায়ে বিক্রি করা দরকার।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নানা ধরনের অসঙ্গতি আছে। যেমন, উপযুক্ত লোকেরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। উপযুক্ত লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলকভাবে বাছাই করা হয়। আবার যাদের সুবিধাভোগীর আওতায় আনা হয়, তারা অপর্যাপ্ত বা কম ভাতা ও পণ্য পাচ্ছেন। কোভিডের পর যুব বেকারত্ব আরও প্রকট হয়েছে। বহু যুবক প্রচ্ছন্ন বেকার হয়ে গেছেন। স্বনিবন্ধনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে তাদের এককালীন ভাতা দেওয়া উচিত। অথবা যুব ক্রেডিট কার্ড চালু করা যেতে পারে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া নিয়ে এক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা আছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় এসেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি- এসব ক্ষেত্রে এক ধরনের আর্থিক সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার চেয়েছে, সেটা যৌক্তিক। কারণ, আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া শুধু টাকার জন্য নয়; সংস্কার ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার জন্যও দরকার। আইএমএফ সম্পর্কে তাদের মনেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, যারা এতদিন অর্থনীতির উন্নয়নের উচ্ছ্বাস নিয়ে ছিলেন। এর ভেতরে যে কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো রয়ে গেছে, তা অস্বীকার করে গেছেন।
আইএমএফ সৃষ্টিই করা হয়েছে এ ধরনের প্রতিকূল সময়ে সাহায্য করার জন্য। সমস্যা হয়েছে, তারা এখন কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন এতদিনের উচ্ছ্বাসপূর্ণ উন্নয়নের কাহিনি। করোনা মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এ বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য হতে পারত মাইলফলক। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সংকটে রূপ দিল ছয় মাস অতিবাহিত হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। গত ২৪ ফেব্রম্নয়ারি ইউক্রেনের ওপর হামলা শুরু করে রাশিয়া। জ¦ালানি ও কৃষিপণ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই দেশ। ফলে সেদিন থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে বিশ্ববাজার। তেল-গ্যাস, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। যুদ্ধের কবলে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই খেই হারাতে শুরু করে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে বারবার কমাতে থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন আশা করছে, বিশ্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৩.২ শতাংশ। যেখানে বছরের শুরুতে পূর্বাভাস ছিল প্রবৃদ্ধি আসবে প্রায় ৫ শতাংশ। ওইসিডির হিসেবে বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু রাশিয়া হচ্ছে জ¦ালানি তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্যের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। একইভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় এ দেশটিকে। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং জ¦ালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ঘন ঘন সুদের হার বাড়াতে থাকে, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সস্নথ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এ বছর চার দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়ানোয় শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি আরও অসহনীয় করে তুলছে। বিশ্বের উন্নত ও উদীয়মান বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু জুলাই মাসেই প্রায় এক হাজার ২০০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির এই ধারা থেকে এটা স্পষ্ট, বিশ্ব অর্থনীতি আবারও সংকোচনের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্ব সম্ভবত একটি মন্দার প্রান্তে চলে এসেছে। সর্বশেষ মন্দার দুই বছর পরই আবার হোঁচট খেল অর্থনীতি।
জ¦ালানি-সংকট নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশি ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান হচ্ছে জ¦ালানি। বর্তমান জ¦ালানি-সংকটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে এগিয়ে যাবে, সেটিই বড় বিষয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে সরকারের কার্যকর হাতিয়ার নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নীতি সুদহার বাড়ালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত-পা নয়-ছয় সুদহারে বাধা। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বৃত্তের বাইরে এক ধরনের চিন্তা করা হয়। বলা হয়, আমরা ব্যতিক্রম। কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বেসিক একই। আর আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান জ¦ালানি। বর্তমানে জ¦ালানি-সংকটের মধ্যে আমরা কিভাবে এগিয়ে যাব, সেটাই এখন বড় বিষয়। তবে জ¦ালানি-সংকট কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। জ¦ালানি খাতের আমদানিনির্ভরতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রেখে জ¦ালানি সাশ্রয় করতে হচ্ছে। জ¦ালানির দাম বাড়ানোর আগে আমরা পরিষ্কার কোনো বার্তা পাইনি। জ¦ালানি নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী, বাংলাদেশের মানুষকে তা জানানো দরকার।
যতদিন ধরে ব্যবসার সহজ করার কথা বলা হচ্ছে, ততদিনে সহজ তো দূরে, ব্যবসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। গত বছর মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তারপর জ¦ালানির দামও বাড়ে। সম্প্রতি জ¦ালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। কাঁচামালের দাম শতভাগ বেড়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও চলতি অর্থবছর উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আর চাপ নিতে পারছে না। বিশ্ববাজারে জ¦ালানির দাম কমলে দেশেও দাম সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সবার একই কথা, বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম কমছে আর আমাদের দেশে কেন বাড়ছে। কবে দাম সমন্বয় করা হবে। বিগত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬-৭ শতাংশ। চলতি মাসে ঠিকভাবে গণনা করলে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে উঠে যাবে। এটি ভয়ের কিছু নয়। যুক্তরাজ্যেও মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সমস্যা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যখন দ্রুত সমন্বয় করতে হয়, তখন মজুরির ওপর চাপ পড়ে। মজুরি বাড়ানোর জন্য চা-বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। কাল হয়তো পোশাক শ্রমিকরা নামবেন। পরশু হয়তো সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে সবাই নামলে বিপদ। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আগেই মজুরি সমন্বয় করতে হবে।
সরকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের উৎপাদন ভালো হবে না। বোরোতেও ক্ষতি হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি আছে। আমদানিও পর্যাপ্ত হয়নি। চালের দাম, মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ সত্যিই কষ্টে আছেন। বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকায় উঠেছে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। সবাই বলছেন, সাম্প্রতিককালে এই দর সর্বোচ্চ। চালের বিকল্প খাদ্য আটার দামও এক মাসে বেড়েছে ২০ শতাংশ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে মাঝারি চাল থেকে সরে মোটা চাল কেনা শুরু করে। এবার মোটা চালের দাম বেশি বাড়ার ক্ষেত্রে একটি কারণ হতে পারে, মানুষ মোটা চাল কেনা বাড়িয়েছে। এতে মোটা চালের বাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য।
চালের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এ কারণে এই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দেখা যায়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। চালের দাম যে বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়, তা আর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। টিসিবি এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে যে তিনটি পণ্য দেয় (ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি) তার সঙ্গে চালও যোগ হবে। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়ানো হবে। এক কোটি দরিদ্র পরিবারের বাইরে আরও এক কোটি সীমিত আয়ের পরিবার দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। সরকার যে সহায়তা দেয়, তা এই ঝুঁকিতে থাকা এক কোটি পরিবারের কাছে পৌঁছায় না। ঢাকায় চাল বিক্রির ট্রাকের পেছনে ভিড় বাড়ছেই। বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। ওএমএসে কম দামে পাওয়া যায় বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চাল কিনেছেন।
বাজারে এখন বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। সরকারও জ¦ালানি তেল, গ্যাস ও পানির দাম বাড়িয়েছে। জ¦ালানির দাম বাড়ানোয় বেড়েছে পরিবহণ ভাড়া। বাড়ানো হয়েছে সারের দাম। সব মিলিয়ে সংসারের ব্যয়ের চাপে মানুষের হিমশিম অবস্থা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
(রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক)
রেজাউল করিম খোকন
৩১ আগস্ট, ২০২২, 12:20 AM

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। কারও জন্য তা আতঙ্কের। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থাকলে অর্থনীতির দুর্বলতা আরও ঘনীভূত হয়, সবল দিকগুলো দুর্বল হতে থাকে। অর্থনীতির নীতি বাস্তবায়ন অনেকটাই আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। তাই আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাই অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম।
মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে ব্যবসা খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় বাড়াতে নানা উদ্ভাবনী ও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমানে আমরা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কেউ কেউ মনে করেন, বৈদেশিক চাপের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটজনক পরিস্থিতি আমাদের চাপে ফেলেছে। কর-জিডিপি অনুপাত এখন মাত্র ৯ শতাংশের মতো। এটি যদি ১৪-১৫ শতাংশ হতো, তাহলে সরকারের আরও বেশি খরচ করার সামর্থ্য থাকত, যা অর্থনীতিকে এক ধরনের স্বস্তি দিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পারছে না। ভর্তুকি দিতে পারছে না। এতদিন ধরে যে উন্নয়ন আলেখ্য রচনা করা হয়েছে, তাতে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বেশি বিনিয়োগ করা হয়নি। ফলে এখন যে উৎপাদনশীল দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার ছিল, তা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের বর্তমান উন্নয়ন নীতিতে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য আছে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতায় তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। এই এগুলো হলো, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা; উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে সমর্থন দেওয়া; বিপন্ন মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এই নীতি সমঝোতা প্রণয়ন ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। এই নীতি সমঝোতা করতে সরকারকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। যেমন, মন্ত্রিপরিষদ; আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কমিটি; অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি-এসব জায়গায় আলোচনা হতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে সরকারের নিজেদের রাজনৈতিক সহযোগী; এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শ্রেণি-পেশার সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা দরকার। সরকারের নীতি প্রণয়নে এক ধরনের স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব আছে। বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে দুই-তিন বছরের জন্য ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা হলে দুই ধরনের উপকার হবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার কাছে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দর কষাকষি সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তাপপূর্ণ কর্মকান্ডের সময়ে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট এই নীতি সমঝোতা অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেবে।
সরকার অবশ্য কিছুকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি ব্যয় সাশ্রয়, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি আনা। এসব পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ, অপর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিকতা নেই। এতদিন অর্থনীতির এই সমস্যাগুলো অস্বীকারের প্রবণতা ছিল। এখন চাপে পড়ে সামান্য স্বীকার করা হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া বিপন্ন মানুষই দুর্দশার সবচেয়ে বড় ভাগিদার। এ মুহূর্তে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান রক্ষা করা বড় অর্থনৈতিক দায়িত্ব। সরকারের ঘোষিত 'ফ্যামিলি কার্ড' ব্যবস্থাকে দ্রম্নততার সঙ্গে ও দুর্নীতিমুক্তভাবে চালু করা দরকার। টিসিবির মাধ্যমে চালসহ অন্য নিত্যপণ্য জেলা পর্যায়ে বিক্রি করা দরকার।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নানা ধরনের অসঙ্গতি আছে। যেমন, উপযুক্ত লোকেরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। উপযুক্ত লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলকভাবে বাছাই করা হয়। আবার যাদের সুবিধাভোগীর আওতায় আনা হয়, তারা অপর্যাপ্ত বা কম ভাতা ও পণ্য পাচ্ছেন। কোভিডের পর যুব বেকারত্ব আরও প্রকট হয়েছে। বহু যুবক প্রচ্ছন্ন বেকার হয়ে গেছেন। স্বনিবন্ধনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে তাদের এককালীন ভাতা দেওয়া উচিত। অথবা যুব ক্রেডিট কার্ড চালু করা যেতে পারে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া নিয়ে এক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা আছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় এসেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি- এসব ক্ষেত্রে এক ধরনের আর্থিক সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার চেয়েছে, সেটা যৌক্তিক। কারণ, আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া শুধু টাকার জন্য নয়; সংস্কার ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার জন্যও দরকার। আইএমএফ সম্পর্কে তাদের মনেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, যারা এতদিন অর্থনীতির উন্নয়নের উচ্ছ্বাস নিয়ে ছিলেন। এর ভেতরে যে কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো রয়ে গেছে, তা অস্বীকার করে গেছেন।
আইএমএফ সৃষ্টিই করা হয়েছে এ ধরনের প্রতিকূল সময়ে সাহায্য করার জন্য। সমস্যা হয়েছে, তারা এখন কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন এতদিনের উচ্ছ্বাসপূর্ণ উন্নয়নের কাহিনি। করোনা মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এ বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য হতে পারত মাইলফলক। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সংকটে রূপ দিল ছয় মাস অতিবাহিত হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। গত ২৪ ফেব্রম্নয়ারি ইউক্রেনের ওপর হামলা শুরু করে রাশিয়া। জ¦ালানি ও কৃষিপণ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই দেশ। ফলে সেদিন থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে বিশ্ববাজার। তেল-গ্যাস, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। যুদ্ধের কবলে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই খেই হারাতে শুরু করে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে বারবার কমাতে থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন আশা করছে, বিশ্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৩.২ শতাংশ। যেখানে বছরের শুরুতে পূর্বাভাস ছিল প্রবৃদ্ধি আসবে প্রায় ৫ শতাংশ। ওইসিডির হিসেবে বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু রাশিয়া হচ্ছে জ¦ালানি তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্যের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। একইভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় এ দেশটিকে। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং জ¦ালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ঘন ঘন সুদের হার বাড়াতে থাকে, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সস্নথ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এ বছর চার দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়ানোয় শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি আরও অসহনীয় করে তুলছে। বিশ্বের উন্নত ও উদীয়মান বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু জুলাই মাসেই প্রায় এক হাজার ২০০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির এই ধারা থেকে এটা স্পষ্ট, বিশ্ব অর্থনীতি আবারও সংকোচনের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্ব সম্ভবত একটি মন্দার প্রান্তে চলে এসেছে। সর্বশেষ মন্দার দুই বছর পরই আবার হোঁচট খেল অর্থনীতি।
জ¦ালানি-সংকট নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশি ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান হচ্ছে জ¦ালানি। বর্তমান জ¦ালানি-সংকটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে এগিয়ে যাবে, সেটিই বড় বিষয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে সরকারের কার্যকর হাতিয়ার নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নীতি সুদহার বাড়ালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত-পা নয়-ছয় সুদহারে বাধা। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বৃত্তের বাইরে এক ধরনের চিন্তা করা হয়। বলা হয়, আমরা ব্যতিক্রম। কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বেসিক একই। আর আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান জ¦ালানি। বর্তমানে জ¦ালানি-সংকটের মধ্যে আমরা কিভাবে এগিয়ে যাব, সেটাই এখন বড় বিষয়। তবে জ¦ালানি-সংকট কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। জ¦ালানি খাতের আমদানিনির্ভরতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রেখে জ¦ালানি সাশ্রয় করতে হচ্ছে। জ¦ালানির দাম বাড়ানোর আগে আমরা পরিষ্কার কোনো বার্তা পাইনি। জ¦ালানি নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী, বাংলাদেশের মানুষকে তা জানানো দরকার।
যতদিন ধরে ব্যবসার সহজ করার কথা বলা হচ্ছে, ততদিনে সহজ তো দূরে, ব্যবসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। গত বছর মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তারপর জ¦ালানির দামও বাড়ে। সম্প্রতি জ¦ালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। কাঁচামালের দাম শতভাগ বেড়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও চলতি অর্থবছর উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আর চাপ নিতে পারছে না। বিশ্ববাজারে জ¦ালানির দাম কমলে দেশেও দাম সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সবার একই কথা, বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দাম কমছে আর আমাদের দেশে কেন বাড়ছে। কবে দাম সমন্বয় করা হবে। বিগত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬-৭ শতাংশ। চলতি মাসে ঠিকভাবে গণনা করলে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে উঠে যাবে। এটি ভয়ের কিছু নয়। যুক্তরাজ্যেও মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সমস্যা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যখন দ্রুত সমন্বয় করতে হয়, তখন মজুরির ওপর চাপ পড়ে। মজুরি বাড়ানোর জন্য চা-বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। কাল হয়তো পোশাক শ্রমিকরা নামবেন। পরশু হয়তো সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে সবাই নামলে বিপদ। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আগেই মজুরি সমন্বয় করতে হবে।
সরকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের উৎপাদন ভালো হবে না। বোরোতেও ক্ষতি হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি আছে। আমদানিও পর্যাপ্ত হয়নি। চালের দাম, মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ সত্যিই কষ্টে আছেন। বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকায় উঠেছে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। সবাই বলছেন, সাম্প্রতিককালে এই দর সর্বোচ্চ। চালের বিকল্প খাদ্য আটার দামও এক মাসে বেড়েছে ২০ শতাংশ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে মাঝারি চাল থেকে সরে মোটা চাল কেনা শুরু করে। এবার মোটা চালের দাম বেশি বাড়ার ক্ষেত্রে একটি কারণ হতে পারে, মানুষ মোটা চাল কেনা বাড়িয়েছে। এতে মোটা চালের বাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য।
চালের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এ কারণে এই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দেখা যায়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। চালের দাম যে বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়, তা আর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। টিসিবি এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে যে তিনটি পণ্য দেয় (ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি) তার সঙ্গে চালও যোগ হবে। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়ানো হবে। এক কোটি দরিদ্র পরিবারের বাইরে আরও এক কোটি সীমিত আয়ের পরিবার দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। সরকার যে সহায়তা দেয়, তা এই ঝুঁকিতে থাকা এক কোটি পরিবারের কাছে পৌঁছায় না। ঢাকায় চাল বিক্রির ট্রাকের পেছনে ভিড় বাড়ছেই। বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। ওএমএসে কম দামে পাওয়া যায় বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চাল কিনেছেন।
বাজারে এখন বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। সরকারও জ¦ালানি তেল, গ্যাস ও পানির দাম বাড়িয়েছে। জ¦ালানির দাম বাড়ানোয় বেড়েছে পরিবহণ ভাড়া। বাড়ানো হয়েছে সারের দাম। সব মিলিয়ে সংসারের ব্যয়ের চাপে মানুষের হিমশিম অবস্থা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
(রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক)