শেরপুরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদারদের ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, 10:44 PM

শেরপুরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদারদের ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে
ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাদপীঠখ্যাত শেরপুর ছিল কামরূপ রাজ্যের অধিভূক্ত। তখন এলাকাটি ছিলো দুর্দান্ত প্রতাপ-প্রভাবশালী জমিদার অধ্যূষিত এলাকা। এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদারদের সেই স্মৃতি চিহ্নগুলো ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যে তাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দাবি উঠেছে।
যুগের বিবর্তন আর কালের পরিক্রমায় কোন কোন জমিদারের শেষ নিদর্শন থাকলেও তাদের দুর্দান্ত প্রতাপের শাসন ও শোষণের নানা চিত্র এখন কেবলই স্মৃতি। তবে লোকমুখে এখনও শোনা যায় তাদের শাসনামলের সেইসব স্মৃতির কথা।
কামরূপ রাজ্যে তখন ভারত সীমান্তের মেঘালয় ঘেঁষা এ অঞ্চলের নাম ছিল ‘শেরপুর পরগণা’, একসময় যা ‘দশকাহনীয়া বাজু’ নামেও পরিচিতি পায়। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনায় শেরপুর পরগণার শেষ জমিদার ছিলেন গাজী বংশের শের আলী গাজী। ইতিহাস বলে, দীর্ঘ ২১ বছরকাল তার শাসনকার্য ইতিবাচকভাবেই পরিচালিত হয় এবং পরবর্তীতে তার নামানুসারেই এ অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘শেরপুর’। পরবর্তীতে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর বিচারে শের আলী গাজীর জমিদারী বাতিল করে রামনাথ চৌধুরীকে শেরপুর পরগনার জমিদারি দেয়া হয়। তিনি ছিলেন শেরপুর পরগণার প্রথম জমিদার। তার উত্তরসূরিরাই পরবর্তীতে ছিলেন শেরপুর পরগণার জমিদার। ১৭৯০ সালে ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ডব্লিউ রাটন শেরপুরের এই জমিদারদের সঙ্গে দশসনা বন্দোবস্ত সম্পাদন করেন। পরবর্তীতে স্টিফেন বায়ার্ডের সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। ১৮২০ সালে শেরপুরের চৌধুরীদের ষোলআনি জমিদারি প্রথমে নয়আনি ও সাত আনিতে ভাগ হয়। পরে সাতআনি বিভক্ত হয় তিনআনি, পৌনে তিনআনি, আড়াইআনি বড় বাড়ি, আড়াইআনি ছোট বাড়ি ও দেড়আনি বাড়িতে।
কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে নয়আনি বাড়ি, তিনআনি বাড়ি, আড়াইআনি বড় বাড়ি, আড়াইআনি ছোট বাড়ি ও দেড় আনি বাড়ি। এর মধ্যে যে নয়আনি বাড়িতে ছিল শিক্ষিত ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটদের বসবাস এবং বিচার পরিচালনা ছিল সেই বাড়ির ব্যক্তিদের অন্যতম শখের অংশ, সেই বাড়ির ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে সেখানে স্থাপিত হয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আর সেই বাড়ির পাশে থাকা প্রকা- নাটমহলের অস্তিত্বও একেবারেই বিলীন। তিনআনি জমিদারবাড়িতে ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয়েছে শেরপুর সরকারি কলেজ। আড়াইআনি বড়বাড়িতে ১৯১৯ সালে স্থাপিত হয়েছে গোবিন্দকুমার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় যা জিকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। এ জমিদারবাড়ির অপরাংশে ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়েছে শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ। মহিলা কলেজটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। এবং পাশে জমিদারদের কর্মচারীদের থাকার মেসবাড়িতে করা হয়েছে বর্তমান জেলা রেজিস্টার, সাব-রেজিস্টার অফিস ও পাশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) অফিস। আড়াইআনি ছোটবাড়িতেও নেই কোন নির্দশন। তবে তাদের বাগানবাড়িটি এখনও বাগানবাড়ি এলাকা নামে পরিচিতি ছড়িয়ে এলেও সেখানে গড়ে উঠেছে বন্দোবস্তের নামে এক শ্রেণির দখলদারদের বসতি। দেড়আনি বাড়ির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে সেখানেও গড়ে উঠেছে বসতি। আজ নেই সেই দুর্দান্ত প্রতাবশালী জমিদাররা, নেই তাদের জমিদারি। আছে শুধু তাদের শাসনকালের নানা গল্পকথা, নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু স্মৃতিচিহ্ন। সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
শেরপুরের জমিদারদের এখন শেষ নিদর্শন হিসেবে আজও জৌলুসপূর্ণ অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে পৌণে তিনআনি বাড়ি। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পৌনে তিনআনী জমিদার কিশোরী মোহন চৌধুরীর আমলে রঙমহল, শীষ মহলসহ নানা সৌধ নির্মাণ করা হয়। এ বাড়ির সর্বশেষ জমিদার ছিলেন সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী। জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি চিরকুমার ছিলেন। সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ছিলেন বিএ-বিএসসি। তারা দুইভাই ছিলেন বিলাসী ও শৌখিন। বিভিন্ন দেশ থেকে গাছপালা এনে তার বাগান করেছিলেন। এদের বৃক্ষপ্রীতি ছিল প্রচুর। এর স্থাপত্যশৈলীর সাথে গ্রিক স্থাপত্যের মিল রয়েছে। যা একে অন্যান্য জমিদার বাড়ি থেকে আলাদা করেছে। চমৎকার নকশা করা স্তম্ভগুলো মুগ্ধ করবে যেকোন দর্শনার্থীকে। অপূর্ব কারুকার্যখচিত সবগুলো ভবন। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রং মহলের তিন অংশ। প্রথম অংশে জমিদারদের খাস দরবার কক্ষ ও জলসা ঘর। দ্বিতীয় অংশে জমিদারদের খাস কামরা। তৃতীয় অংশে নায়েব-ম্যানেজারের কাচারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রং মহলের প্রবেশ পথের দরজা দুটি। ডানদিকের দরজা বরাবর টানা লম্বা করিডোর। করিডোর ও ভিতরের অর্ধেক দেয়াল জুড়ে বিরাজ করছে রঙিন চিনাপাথরের ফ্রেসকো ও ফুল লতাপাতার আঁকা টালি বসানো। কবির ভাষায় ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে মোর কবিতাখানি-র মতো শতবর্ষ পরও সেগুলোর ঔজ্জ্বল্য আজও চির যৌবন, চির উজ্জল’। জমিদার বাড়ির ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রং মহল। চমৎকার বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় জমিদার কেমন সংস্কৃতি প্রিয় ছিলেন! নাচ গানসহ অন্যান্য সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানেই হতো। রং মহলের ডানদিক ঘেঁষে শান বাঁধানো পুকুর। জলে জলসা ঘর প্রতিবিম্বিত হয়। সেই আমলে রঙ মহলের দীর্ঘ করিডোর ধরে প্রতিটি কক্ষে ঢোকার দরজার পাশে ছিল বিরাট আকারের নান্দনিক ফুলদানি এবং পিতল ও পাথরের নানা ধরনের মূর্তি।
শেরপুরের জমিদারদের মধ্যে পৌনে তিনআনী জমিদার পরিবার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তাদের ছিল জয় কিশোর লাইব্রেরি ভবন, কূল দেবতা অন্নপূর্ণা-গোপীনাথের অপরূপ সুন্দর মন্দির। যার মাঝে রয়েছে- প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও মুসলিম স্থাপত্যরীতির অপূর্ব সুসমন্বয়। লাইব্রেরিতে ছিল ৫ সহস্রাধিক বই। অধিকাংশই বিজ্ঞান বিষয়ক। পরের আধুনিক ইতিহাসে জমিদার বাড়িটিকে ১৯৫৭ সালে কৃষি প্রশিক্ষণালয়ে রূপান্তরিত করা হলে লাইব্রেরি ভবনটি ভেঙে সেখানে টিনশেডের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়। রঙ মহলটি এক সময় কৃষি প্রশিক্ষণালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তা আর ব্যবহার হচ্ছে না। বরং অনেকটা অযতœ আর অবহেলায় পৌণে তিনআনি জমিদারবাড়ির সেই ভবনগুলো এখন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, সামান্য বৃষ্টিতেই এর ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। স্থানে স্থানে সুরকির গাঁথুনিগুলো হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। পলেস্তারা খুলে পড়ছে যখন তখন। যেন দেখার কেউ নেই।
শেরপুর অঞ্চলে জমিদারদের শেষ নিদর্শনগুলো বিলীন হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে জেলা জনউদ্যোগ এর আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ অঞ্চলের জমিদারদের শেষ নিদর্শন পৌণে তিনআনি বাড়ি। কিন্তু অযতœ-অবহেলা ও উদাসিনতার কারণে সেই নিদর্শনটির অস্তিত্বও এখন হুমকির সম্মুখীন।
সিনিয়র সাংবাদিক হাকিম বাবুল বলেন, ১৯৯১ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সাম্প্রদায়িতকার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয় আনী বাড়িতে অবস্থিত দৃষ্টি নন্দন কারুকার্যখ”িত নাট্য মন্দির তরিঘড়ি করে ভেঙ্গে ফেলেন। তখন দল মত নির্বিশেষে শেরপুরের সুশীল সমাজ এর প্রতিবাদ করলেও জেলা প্রশাসক কোন কর্ণপাত করেননি। সাংবাদিক হাকিম বলেন, শেরপুরের জমিদারদের স্থাপনাগুলোকে সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার।
শেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া বলেন, সরকার শেরপুর অঞ্চলকে পর্যটনের এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেই সাথে জমিদার এবং মোঘলদের স্থাপনাগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
অনলাইন ডেস্ক
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, 10:44 PM

ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাদপীঠখ্যাত শেরপুর ছিল কামরূপ রাজ্যের অধিভূক্ত। তখন এলাকাটি ছিলো দুর্দান্ত প্রতাপ-প্রভাবশালী জমিদার অধ্যূষিত এলাকা। এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদারদের সেই স্মৃতি চিহ্নগুলো ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যে তাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দাবি উঠেছে।
যুগের বিবর্তন আর কালের পরিক্রমায় কোন কোন জমিদারের শেষ নিদর্শন থাকলেও তাদের দুর্দান্ত প্রতাপের শাসন ও শোষণের নানা চিত্র এখন কেবলই স্মৃতি। তবে লোকমুখে এখনও শোনা যায় তাদের শাসনামলের সেইসব স্মৃতির কথা।
কামরূপ রাজ্যে তখন ভারত সীমান্তের মেঘালয় ঘেঁষা এ অঞ্চলের নাম ছিল ‘শেরপুর পরগণা’, একসময় যা ‘দশকাহনীয়া বাজু’ নামেও পরিচিতি পায়। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনায় শেরপুর পরগণার শেষ জমিদার ছিলেন গাজী বংশের শের আলী গাজী। ইতিহাস বলে, দীর্ঘ ২১ বছরকাল তার শাসনকার্য ইতিবাচকভাবেই পরিচালিত হয় এবং পরবর্তীতে তার নামানুসারেই এ অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘শেরপুর’। পরবর্তীতে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর বিচারে শের আলী গাজীর জমিদারী বাতিল করে রামনাথ চৌধুরীকে শেরপুর পরগনার জমিদারি দেয়া হয়। তিনি ছিলেন শেরপুর পরগণার প্রথম জমিদার। তার উত্তরসূরিরাই পরবর্তীতে ছিলেন শেরপুর পরগণার জমিদার। ১৭৯০ সালে ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ডব্লিউ রাটন শেরপুরের এই জমিদারদের সঙ্গে দশসনা বন্দোবস্ত সম্পাদন করেন। পরবর্তীতে স্টিফেন বায়ার্ডের সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। ১৮২০ সালে শেরপুরের চৌধুরীদের ষোলআনি জমিদারি প্রথমে নয়আনি ও সাত আনিতে ভাগ হয়। পরে সাতআনি বিভক্ত হয় তিনআনি, পৌনে তিনআনি, আড়াইআনি বড় বাড়ি, আড়াইআনি ছোট বাড়ি ও দেড়আনি বাড়িতে।
কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে নয়আনি বাড়ি, তিনআনি বাড়ি, আড়াইআনি বড় বাড়ি, আড়াইআনি ছোট বাড়ি ও দেড় আনি বাড়ি। এর মধ্যে যে নয়আনি বাড়িতে ছিল শিক্ষিত ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটদের বসবাস এবং বিচার পরিচালনা ছিল সেই বাড়ির ব্যক্তিদের অন্যতম শখের অংশ, সেই বাড়ির ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে সেখানে স্থাপিত হয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আর সেই বাড়ির পাশে থাকা প্রকা- নাটমহলের অস্তিত্বও একেবারেই বিলীন। তিনআনি জমিদারবাড়িতে ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয়েছে শেরপুর সরকারি কলেজ। আড়াইআনি বড়বাড়িতে ১৯১৯ সালে স্থাপিত হয়েছে গোবিন্দকুমার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় যা জিকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। এ জমিদারবাড়ির অপরাংশে ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়েছে শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ। মহিলা কলেজটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। এবং পাশে জমিদারদের কর্মচারীদের থাকার মেসবাড়িতে করা হয়েছে বর্তমান জেলা রেজিস্টার, সাব-রেজিস্টার অফিস ও পাশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) অফিস। আড়াইআনি ছোটবাড়িতেও নেই কোন নির্দশন। তবে তাদের বাগানবাড়িটি এখনও বাগানবাড়ি এলাকা নামে পরিচিতি ছড়িয়ে এলেও সেখানে গড়ে উঠেছে বন্দোবস্তের নামে এক শ্রেণির দখলদারদের বসতি। দেড়আনি বাড়ির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে সেখানেও গড়ে উঠেছে বসতি। আজ নেই সেই দুর্দান্ত প্রতাবশালী জমিদাররা, নেই তাদের জমিদারি। আছে শুধু তাদের শাসনকালের নানা গল্পকথা, নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু স্মৃতিচিহ্ন। সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
শেরপুরের জমিদারদের এখন শেষ নিদর্শন হিসেবে আজও জৌলুসপূর্ণ অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে পৌণে তিনআনি বাড়ি। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পৌনে তিনআনী জমিদার কিশোরী মোহন চৌধুরীর আমলে রঙমহল, শীষ মহলসহ নানা সৌধ নির্মাণ করা হয়। এ বাড়ির সর্বশেষ জমিদার ছিলেন সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী। জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি চিরকুমার ছিলেন। সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ছিলেন বিএ-বিএসসি। তারা দুইভাই ছিলেন বিলাসী ও শৌখিন। বিভিন্ন দেশ থেকে গাছপালা এনে তার বাগান করেছিলেন। এদের বৃক্ষপ্রীতি ছিল প্রচুর। এর স্থাপত্যশৈলীর সাথে গ্রিক স্থাপত্যের মিল রয়েছে। যা একে অন্যান্য জমিদার বাড়ি থেকে আলাদা করেছে। চমৎকার নকশা করা স্তম্ভগুলো মুগ্ধ করবে যেকোন দর্শনার্থীকে। অপূর্ব কারুকার্যখচিত সবগুলো ভবন। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রং মহলের তিন অংশ। প্রথম অংশে জমিদারদের খাস দরবার কক্ষ ও জলসা ঘর। দ্বিতীয় অংশে জমিদারদের খাস কামরা। তৃতীয় অংশে নায়েব-ম্যানেজারের কাচারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রং মহলের প্রবেশ পথের দরজা দুটি। ডানদিকের দরজা বরাবর টানা লম্বা করিডোর। করিডোর ও ভিতরের অর্ধেক দেয়াল জুড়ে বিরাজ করছে রঙিন চিনাপাথরের ফ্রেসকো ও ফুল লতাপাতার আঁকা টালি বসানো। কবির ভাষায় ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে মোর কবিতাখানি-র মতো শতবর্ষ পরও সেগুলোর ঔজ্জ্বল্য আজও চির যৌবন, চির উজ্জল’। জমিদার বাড়ির ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রং মহল। চমৎকার বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় জমিদার কেমন সংস্কৃতি প্রিয় ছিলেন! নাচ গানসহ অন্যান্য সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানেই হতো। রং মহলের ডানদিক ঘেঁষে শান বাঁধানো পুকুর। জলে জলসা ঘর প্রতিবিম্বিত হয়। সেই আমলে রঙ মহলের দীর্ঘ করিডোর ধরে প্রতিটি কক্ষে ঢোকার দরজার পাশে ছিল বিরাট আকারের নান্দনিক ফুলদানি এবং পিতল ও পাথরের নানা ধরনের মূর্তি।
শেরপুরের জমিদারদের মধ্যে পৌনে তিনআনী জমিদার পরিবার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তাদের ছিল জয় কিশোর লাইব্রেরি ভবন, কূল দেবতা অন্নপূর্ণা-গোপীনাথের অপরূপ সুন্দর মন্দির। যার মাঝে রয়েছে- প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও মুসলিম স্থাপত্যরীতির অপূর্ব সুসমন্বয়। লাইব্রেরিতে ছিল ৫ সহস্রাধিক বই। অধিকাংশই বিজ্ঞান বিষয়ক। পরের আধুনিক ইতিহাসে জমিদার বাড়িটিকে ১৯৫৭ সালে কৃষি প্রশিক্ষণালয়ে রূপান্তরিত করা হলে লাইব্রেরি ভবনটি ভেঙে সেখানে টিনশেডের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়। রঙ মহলটি এক সময় কৃষি প্রশিক্ষণালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তা আর ব্যবহার হচ্ছে না। বরং অনেকটা অযতœ আর অবহেলায় পৌণে তিনআনি জমিদারবাড়ির সেই ভবনগুলো এখন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, সামান্য বৃষ্টিতেই এর ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। স্থানে স্থানে সুরকির গাঁথুনিগুলো হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। পলেস্তারা খুলে পড়ছে যখন তখন। যেন দেখার কেউ নেই।
শেরপুর অঞ্চলে জমিদারদের শেষ নিদর্শনগুলো বিলীন হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে জেলা জনউদ্যোগ এর আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ অঞ্চলের জমিদারদের শেষ নিদর্শন পৌণে তিনআনি বাড়ি। কিন্তু অযতœ-অবহেলা ও উদাসিনতার কারণে সেই নিদর্শনটির অস্তিত্বও এখন হুমকির সম্মুখীন।
সিনিয়র সাংবাদিক হাকিম বাবুল বলেন, ১৯৯১ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সাম্প্রদায়িতকার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয় আনী বাড়িতে অবস্থিত দৃষ্টি নন্দন কারুকার্যখ”িত নাট্য মন্দির তরিঘড়ি করে ভেঙ্গে ফেলেন। তখন দল মত নির্বিশেষে শেরপুরের সুশীল সমাজ এর প্রতিবাদ করলেও জেলা প্রশাসক কোন কর্ণপাত করেননি। সাংবাদিক হাকিম বলেন, শেরপুরের জমিদারদের স্থাপনাগুলোকে সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার।
শেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া বলেন, সরকার শেরপুর অঞ্চলকে পর্যটনের এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেই সাথে জমিদার এবং মোঘলদের স্থাপনাগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।