বাইক লেন এবং বাইকারদের রাজপথ

মোমিন মেহেদী
১৯ জুলাই, ২০২২, 12:31 AM

বাইক লেন এবং বাইকারদের রাজপথ
আমি বরাবরই বাইকার হিসেবে ভালো ছিলাম। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে আমার প্রিয় এক ছাত্র নেতা বলেছিলেন, বাইকার হিসেবে তুমি খুব ভালো; নিয়মও মানো; তোমার মত সবাই নিয়ম মানলে বাইক দুর্ঘটনা কমে যেতো। তিনি এখন ক্ষমতাসীন লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। আজ যখন বাইক লেন-এর দাবিতে রাজপথে সেভ দ্য রোড-এর ব্যানারে কথা বলি, তখন তিনি ফোন করে বলেন, এই দাবিটা আমারও। কারণ, তিনি নিজে এখনো শখের বাইকার। এমন অসংখ্য বাইকারদের কারণে নিবন্ধিত যানের চার ভাগের তিনভাগই বাইক। শিরোনামটি দেখে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই! কারণ বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে বাইকের জন্য পৃথক লেন রয়েছে; আর পৃথক লেনের ব্যবস্থা বাংলাদেশে হলেই সকল রকম ভয় আর সংশয় কেটে যাবে বলে বিশ^াস করি যৌক্তিক বিবেচনায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে অর্থনীতির অবস্থা দূর্বল থাকায় প্রথম দিকে কেউ কেউ মোটর সাইকেল কিনলেও অতটা জনপ্রিয় ছিলো না; যা গত ৪৯ বছরে হয়েছে। ৪৮ বছরে জনপ্রিয়তাই কেবল বাড়েনি; বিক্রিও বেড়েছে ৪৮ গুণ। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও জনপ্রিয় এই বাইকের রেজিষ্ট্রেশন ফি বাড়তে বাড়তে এখন নেয়া হচ্ছে মোট ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু করা হয়নি দেশের কোন সেতু বা সড়কে পৃথক বাইক লেন। নেই স্বয়ং স্বপ্নের সেতু খ্যাত পদ্মা সেতুতেও। আর এই বাইক লেন না থাকায় বাইকারদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে অন্যান্য ভাড়ি পরিবহনগুলো যখন তখন; সেই সাথে আছে কিছু বাইকারের দ্রুতগতিতে চালানোর দোষও। সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রতি ১০ হাজার বাইকের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে ২৮ জনের - নিহতদের ৪০ ভাগের বয়স ২৪-৩০। এদের মধ্যে আবার ৬৬%-এরও বেশি শৃঙ্খলা মানেন না, নিয়মিত হেলমেট ব্যবহার করেন না বলেও অভিযোগ করেছে ট্রাফিক বিভাগ।
দ্রুত গতি সম্পন্ন, জ্যামমুক্তভাবে বাইক তার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌছতে পারে বলে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছে; আর সেই সুবাদে দেশে বেড়েছে বাইকের ব্যবহার। এটা কোন অন্যায়-অপরাধ নয়; দেশের রাজস্ব খাতে বরং যোগ হয়েছে বছরে প্রায় ১ শ কোটি টাকার। সেই সাথে আইন না মানার কারণে মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় উপার্জিত অর্থও নেহাৎ কম নয়। রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিআরটিএ) হিসাবে দেখা যায়, দেশে রেজিস্ট্রেশন করা যানবাহনের সংখ্যা সাড়ে ৫৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই সাড়ে ৩৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করা যানবাহনের মধ্যে প্রায় চারভাগের তিনভাগই হলো বাইক! যার একটা বড় অংশ গণপরিবহণ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহণ করছে। কেন এত বাইকের নিবন্ধন? কারণ একটাই- বাইক মানেই সহজ যোগাযোগ বাহন। এবার ঈদে বাইকে বিধি নিষেধ থাকায় ১৮ লক্ষ মানুষকে বিশেষ বিড়ম্বনা সহ্য করে বাড়িতে যেতে হয়েছে। অথচ বাইক লেনের ব্যবস্থা করে আইনগুলো কঠোরভাবে পালনের নির্দেশনা দিলে বাইকাররাও সস্তিতে বাড়িতে যেতে পারতো, কমতো লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোগান্তি।
দেশ স্বাধীনের পর ৪৯ বছরে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ গুণ। দুই চাকার এই যান কোনো অবস্থাতেই গণপরিবহণ বা গণপরিবহণের বিকল্প হয়নি, হবেও না। তবে ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে বিশে^র অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের মানুষেরও প্রথম পছন্দ বাইক। তবে একটা কথা সত্য, গণপরিবহনে ভয়ংকর জ্যাম, ভোগান্তি আর চরম নৈরাজ্যের কারণে গত ১৩ বছরে দেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশসহ অন্য অনেক দেশের তুলনায় দেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম, এ বিষয়টি সবার মনে রাখা প্রয়োজন। দেশে এখন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি ৫৪ জনে মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন একজন। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল প্রতি ১৬১ জনে মাত্র একজন। অথচ মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ হার প্রতি ২০ জনে একজন। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় প্রতি চারজনে একজন। অর্থাৎ ভারতে ৫ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ২৫ শতাংশ মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহার করে; কারণ এসব দেশে গণপরিবহন মান সম্মত; রাস্তায় তেমন যানজটও নেই। অনেকে বলে থাকেন, ভিয়েতনামে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে ৩৫৮টি। এর বিপরীতে বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য মোটরসাইকেল আছে মাত্র ৭টি। তবে দেশে সড়ক- সেতু কোথাও পৃথক বাইক লেন না থাকা, আইন না মানা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেশি, সেভ দ্য রোড-এর এমন তথ্যের পরও সরকার বাইক লেন-এর উদ্যেগ গ্রহণ করেনি। নেয়নি আইন মানানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ। কি কারণ? কারণ হ-য-ব-র-ল থাকলেই লাভ আমাদের পুলিশ-প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের। তাতে করে একবার বাইক কোপম্পানিগুলোকে ভয় দেখাবে; আরেকবার বাইকারদেরকে; মধ্যিখানে নির্মমতার হাত দিয়ে কামিয়ে নেবে অবৈধ অর্থ।
আমাদের দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ ইন্দোনেশিয়ায় বছরে ৩৮ লাখ, ভিয়েতনামে ২৮ লাখ, পাকিস্তানে ২০ লাখ ও থাইল্যান্ডে ১৫ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। এর বিপরীতে বাংলাদেশে এ সংখ্যা এখনো ৬ লাখের কম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্থানীয় উৎপাদনও। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে এখানে ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চলতি বছরের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে এখন নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় আছে ৯ লাখ ৬১ হাজার ২২১টি। এই বড় অংকের বাইকারদের জন্য নির্মম পথ দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে বাইক লেনই প্রধান উপায়। পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং স্পিডগানের কোন বিকল্প নেই।
বিশ^ব্যাপী প্রত্যয়ী গবেষকদের মতে- মোটরসাইকেল মানেই বিপদ নয়। বরং অসংখ্য মানুষের উপকারি এই বাহনটি নিয়মিত চালালে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অনেক উপকার পেতে পারেন। মোটরসাইকেল চালানোর উপকারিতা প্রচুর। যেমন-
১. মোটরসাইকেল চালালে আপনার হাঁটু এবং থাইয়ের জোর বাড়ে। যাঁরা মোটরসাইকেল চালান, তাঁদের হাঁটুর সমস্যা বাকিদের থেকে তূলনামূলক কম হয়। যেসকল মাংশপেশিগুলি হাঁটুর হাড়গুলি সঠিক জায়গায় ধরে রাখতে সাহায্য করে মোটরসাইকেল চালালে সেই মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। ২. মোটরসাইকেল নাড়াচাড়া করতে, বিশেষত অল্প গতিতে মোটরসাইকেল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে পেটের আশেপাশে থাকা মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। ৩. মোটরসাইকেল চালানোর শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে, শরীরে ফ্যাট কম জমে। ফলে বাড়তি ওজন ঝরানো ছাড়াও ব্লাড সুগার লেভেল কমে। যাঁদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরা এর ফলে বিশেষ ভাবে উপকৃত হন। ৪. বাতাসের বিপরীতে মোটরসাইকেল চালানোর ফলে লক্ষ্যণীয়ভাবে শরীরের ক্যালোরি ঝরে। শুধু তাই নয়, হাওয়ার বিরুদ্ধে শরীরকে মোটরসাইকেলের উপরে ধরে রাখার ফলে শরীরের মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। যাঁরা প্রোফেশনালি রেসট্র্যাকে মোটরসাইকেল রেস করেন, তাঁরা ঘণ্টায় ৬০০ ক্যালোরি পর্যন্ত ঝরাতে পারেন। অন্যদের ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩০০ কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ ক্যালোরি ঝরে। ৫. আপনার মোটরসাইকেলটি যদি আপনার সাথে পুরোপুরি খাপ না খায়, বা মোটরসাইকেলে বসতে অসুবিধা হয়, তাহলে আপনার ব্যাকপেইন, শোল্ডার পেইন, ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। কিন্তু একটু সতর্ক হয়ে মানানসই মোটরসাইকেল ব্যবহার করলে এবং সর্বদা হেলমেট পড়লে আপনার ঘাড়ের হাড় মজবুত হয়। ৬. মোটরসাইকেলে একটা লং রাইড করে আসার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ সতেজ লাগে।
একথা সবাই-ই কমবেশি জানি যে, মোটরসাইকেল চালানোর সময়ে রোজকার বিভিন্ন সমস্যা ভুলে থেকে মানসিকভাবে চাঙ্গা হওয়া যায়। মোটরসাইকেল চালানোর সময়ে শরীর থেকে বেশি পরিমাণে এন্ডোরফিনস নামে একটি রাসায়নিক বেরিয়ে যায় যা আপনাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা হতে সাহায্য করে। ভুল তথ্য সারাদেশে সকল স্থানে ছড়িয়ে থাকার কারণে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে যে মোটরসাইকেল রাইডিং শরীরের অনেক ক্ষতি করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মোটরসাইকেল চালানোর উপকারিতা অসংখ্য। রাইডিং আমাদের শরীরের প্রচুর উপকার করে এবং মোটরসাইকেল রাইডিং এর মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন আরেকটু বেশি ফিট এবং শক্তিশালি হই। আমাদের গন্তব্যে আমরা যেন দুর্ঘটনামুক্তভাবে পৌছে যাই; এজন্য চাই বাইক লেন-নিয়ম মানা আর সবার সতর্ক পথচলা। বাইক লেন না করে বাইককে নিষিদ্ধ যারা করেছে বা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত ভুল তথ্য পৌছে দিয়ে এমন একটি বাহনকে কলুষিত করেছে নিসন্দেহে তারা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের লোভে অন্ধপ্রায়। এদেরকে কেউ চিহ্নিত করুক বা না করুক অনতিবিলম্বে আরো একটি লেখায় চিহ্নিত করে তুলে ধরবো বলে আশাবাদী আমি। কিন্তু পাঠক-বাইকারগণ কতটা আশাবাদী তা দেখা যাবে বাইক লেন-এর দাবিতে যখন সেভ দ্য রোড রাস্তায় থাকবে, থাকবো আমিও; তখন উপস্থিতি দেখে বুঝতে পারবো বাঙালি কি এখনো নির্মমতার রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাবে, না কি দাবি আদায়ে থাকবে ভয় আর সংশয়কে পেছনে ফেলে লোভ মোহহীন নিবেদিত নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি এবং প্রতিষ্ঠাতা, সেভ দ্য রোড।
মোমিন মেহেদী
১৯ জুলাই, ২০২২, 12:31 AM

আমি বরাবরই বাইকার হিসেবে ভালো ছিলাম। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে আমার প্রিয় এক ছাত্র নেতা বলেছিলেন, বাইকার হিসেবে তুমি খুব ভালো; নিয়মও মানো; তোমার মত সবাই নিয়ম মানলে বাইক দুর্ঘটনা কমে যেতো। তিনি এখন ক্ষমতাসীন লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। আজ যখন বাইক লেন-এর দাবিতে রাজপথে সেভ দ্য রোড-এর ব্যানারে কথা বলি, তখন তিনি ফোন করে বলেন, এই দাবিটা আমারও। কারণ, তিনি নিজে এখনো শখের বাইকার। এমন অসংখ্য বাইকারদের কারণে নিবন্ধিত যানের চার ভাগের তিনভাগই বাইক। শিরোনামটি দেখে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই! কারণ বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে বাইকের জন্য পৃথক লেন রয়েছে; আর পৃথক লেনের ব্যবস্থা বাংলাদেশে হলেই সকল রকম ভয় আর সংশয় কেটে যাবে বলে বিশ^াস করি যৌক্তিক বিবেচনায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে অর্থনীতির অবস্থা দূর্বল থাকায় প্রথম দিকে কেউ কেউ মোটর সাইকেল কিনলেও অতটা জনপ্রিয় ছিলো না; যা গত ৪৯ বছরে হয়েছে। ৪৮ বছরে জনপ্রিয়তাই কেবল বাড়েনি; বিক্রিও বেড়েছে ৪৮ গুণ। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও জনপ্রিয় এই বাইকের রেজিষ্ট্রেশন ফি বাড়তে বাড়তে এখন নেয়া হচ্ছে মোট ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু করা হয়নি দেশের কোন সেতু বা সড়কে পৃথক বাইক লেন। নেই স্বয়ং স্বপ্নের সেতু খ্যাত পদ্মা সেতুতেও। আর এই বাইক লেন না থাকায় বাইকারদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে অন্যান্য ভাড়ি পরিবহনগুলো যখন তখন; সেই সাথে আছে কিছু বাইকারের দ্রুতগতিতে চালানোর দোষও। সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রতি ১০ হাজার বাইকের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে ২৮ জনের - নিহতদের ৪০ ভাগের বয়স ২৪-৩০। এদের মধ্যে আবার ৬৬%-এরও বেশি শৃঙ্খলা মানেন না, নিয়মিত হেলমেট ব্যবহার করেন না বলেও অভিযোগ করেছে ট্রাফিক বিভাগ।
দ্রুত গতি সম্পন্ন, জ্যামমুক্তভাবে বাইক তার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌছতে পারে বলে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছে; আর সেই সুবাদে দেশে বেড়েছে বাইকের ব্যবহার। এটা কোন অন্যায়-অপরাধ নয়; দেশের রাজস্ব খাতে বরং যোগ হয়েছে বছরে প্রায় ১ শ কোটি টাকার। সেই সাথে আইন না মানার কারণে মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় উপার্জিত অর্থও নেহাৎ কম নয়। রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিআরটিএ) হিসাবে দেখা যায়, দেশে রেজিস্ট্রেশন করা যানবাহনের সংখ্যা সাড়ে ৫৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই সাড়ে ৩৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করা যানবাহনের মধ্যে প্রায় চারভাগের তিনভাগই হলো বাইক! যার একটা বড় অংশ গণপরিবহণ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহণ করছে। কেন এত বাইকের নিবন্ধন? কারণ একটাই- বাইক মানেই সহজ যোগাযোগ বাহন। এবার ঈদে বাইকে বিধি নিষেধ থাকায় ১৮ লক্ষ মানুষকে বিশেষ বিড়ম্বনা সহ্য করে বাড়িতে যেতে হয়েছে। অথচ বাইক লেনের ব্যবস্থা করে আইনগুলো কঠোরভাবে পালনের নির্দেশনা দিলে বাইকাররাও সস্তিতে বাড়িতে যেতে পারতো, কমতো লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোগান্তি।
দেশ স্বাধীনের পর ৪৯ বছরে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ গুণ। দুই চাকার এই যান কোনো অবস্থাতেই গণপরিবহণ বা গণপরিবহণের বিকল্প হয়নি, হবেও না। তবে ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে বিশে^র অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের মানুষেরও প্রথম পছন্দ বাইক। তবে একটা কথা সত্য, গণপরিবহনে ভয়ংকর জ্যাম, ভোগান্তি আর চরম নৈরাজ্যের কারণে গত ১৩ বছরে দেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশসহ অন্য অনেক দেশের তুলনায় দেশে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম, এ বিষয়টি সবার মনে রাখা প্রয়োজন। দেশে এখন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি ৫৪ জনে মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন একজন। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল প্রতি ১৬১ জনে মাত্র একজন। অথচ মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ হার প্রতি ২০ জনে একজন। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় প্রতি চারজনে একজন। অর্থাৎ ভারতে ৫ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ২৫ শতাংশ মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহার করে; কারণ এসব দেশে গণপরিবহন মান সম্মত; রাস্তায় তেমন যানজটও নেই। অনেকে বলে থাকেন, ভিয়েতনামে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে ৩৫৮টি। এর বিপরীতে বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য মোটরসাইকেল আছে মাত্র ৭টি। তবে দেশে সড়ক- সেতু কোথাও পৃথক বাইক লেন না থাকা, আইন না মানা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেশি, সেভ দ্য রোড-এর এমন তথ্যের পরও সরকার বাইক লেন-এর উদ্যেগ গ্রহণ করেনি। নেয়নি আইন মানানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ। কি কারণ? কারণ হ-য-ব-র-ল থাকলেই লাভ আমাদের পুলিশ-প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের। তাতে করে একবার বাইক কোপম্পানিগুলোকে ভয় দেখাবে; আরেকবার বাইকারদেরকে; মধ্যিখানে নির্মমতার হাত দিয়ে কামিয়ে নেবে অবৈধ অর্থ।
আমাদের দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ ইন্দোনেশিয়ায় বছরে ৩৮ লাখ, ভিয়েতনামে ২৮ লাখ, পাকিস্তানে ২০ লাখ ও থাইল্যান্ডে ১৫ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। এর বিপরীতে বাংলাদেশে এ সংখ্যা এখনো ৬ লাখের কম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্থানীয় উৎপাদনও। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে এখানে ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চলতি বছরের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে এখন নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় আছে ৯ লাখ ৬১ হাজার ২২১টি। এই বড় অংকের বাইকারদের জন্য নির্মম পথ দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে বাইক লেনই প্রধান উপায়। পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং স্পিডগানের কোন বিকল্প নেই।
বিশ^ব্যাপী প্রত্যয়ী গবেষকদের মতে- মোটরসাইকেল মানেই বিপদ নয়। বরং অসংখ্য মানুষের উপকারি এই বাহনটি নিয়মিত চালালে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অনেক উপকার পেতে পারেন। মোটরসাইকেল চালানোর উপকারিতা প্রচুর। যেমন-
১. মোটরসাইকেল চালালে আপনার হাঁটু এবং থাইয়ের জোর বাড়ে। যাঁরা মোটরসাইকেল চালান, তাঁদের হাঁটুর সমস্যা বাকিদের থেকে তূলনামূলক কম হয়। যেসকল মাংশপেশিগুলি হাঁটুর হাড়গুলি সঠিক জায়গায় ধরে রাখতে সাহায্য করে মোটরসাইকেল চালালে সেই মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। ২. মোটরসাইকেল নাড়াচাড়া করতে, বিশেষত অল্প গতিতে মোটরসাইকেল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে পেটের আশেপাশে থাকা মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। ৩. মোটরসাইকেল চালানোর শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে, শরীরে ফ্যাট কম জমে। ফলে বাড়তি ওজন ঝরানো ছাড়াও ব্লাড সুগার লেভেল কমে। যাঁদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরা এর ফলে বিশেষ ভাবে উপকৃত হন। ৪. বাতাসের বিপরীতে মোটরসাইকেল চালানোর ফলে লক্ষ্যণীয়ভাবে শরীরের ক্যালোরি ঝরে। শুধু তাই নয়, হাওয়ার বিরুদ্ধে শরীরকে মোটরসাইকেলের উপরে ধরে রাখার ফলে শরীরের মাংসপেশিগুলির জোর বাড়ে। যাঁরা প্রোফেশনালি রেসট্র্যাকে মোটরসাইকেল রেস করেন, তাঁরা ঘণ্টায় ৬০০ ক্যালোরি পর্যন্ত ঝরাতে পারেন। অন্যদের ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩০০ কমপক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ ক্যালোরি ঝরে। ৫. আপনার মোটরসাইকেলটি যদি আপনার সাথে পুরোপুরি খাপ না খায়, বা মোটরসাইকেলে বসতে অসুবিধা হয়, তাহলে আপনার ব্যাকপেইন, শোল্ডার পেইন, ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। কিন্তু একটু সতর্ক হয়ে মানানসই মোটরসাইকেল ব্যবহার করলে এবং সর্বদা হেলমেট পড়লে আপনার ঘাড়ের হাড় মজবুত হয়। ৬. মোটরসাইকেলে একটা লং রাইড করে আসার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ সতেজ লাগে।
একথা সবাই-ই কমবেশি জানি যে, মোটরসাইকেল চালানোর সময়ে রোজকার বিভিন্ন সমস্যা ভুলে থেকে মানসিকভাবে চাঙ্গা হওয়া যায়। মোটরসাইকেল চালানোর সময়ে শরীর থেকে বেশি পরিমাণে এন্ডোরফিনস নামে একটি রাসায়নিক বেরিয়ে যায় যা আপনাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা হতে সাহায্য করে। ভুল তথ্য সারাদেশে সকল স্থানে ছড়িয়ে থাকার কারণে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে যে মোটরসাইকেল রাইডিং শরীরের অনেক ক্ষতি করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মোটরসাইকেল চালানোর উপকারিতা অসংখ্য। রাইডিং আমাদের শরীরের প্রচুর উপকার করে এবং মোটরসাইকেল রাইডিং এর মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন আরেকটু বেশি ফিট এবং শক্তিশালি হই। আমাদের গন্তব্যে আমরা যেন দুর্ঘটনামুক্তভাবে পৌছে যাই; এজন্য চাই বাইক লেন-নিয়ম মানা আর সবার সতর্ক পথচলা। বাইক লেন না করে বাইককে নিষিদ্ধ যারা করেছে বা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত ভুল তথ্য পৌছে দিয়ে এমন একটি বাহনকে কলুষিত করেছে নিসন্দেহে তারা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের লোভে অন্ধপ্রায়। এদেরকে কেউ চিহ্নিত করুক বা না করুক অনতিবিলম্বে আরো একটি লেখায় চিহ্নিত করে তুলে ধরবো বলে আশাবাদী আমি। কিন্তু পাঠক-বাইকারগণ কতটা আশাবাদী তা দেখা যাবে বাইক লেন-এর দাবিতে যখন সেভ দ্য রোড রাস্তায় থাকবে, থাকবো আমিও; তখন উপস্থিতি দেখে বুঝতে পারবো বাঙালি কি এখনো নির্মমতার রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাবে, না কি দাবি আদায়ে থাকবে ভয় আর সংশয়কে পেছনে ফেলে লোভ মোহহীন নিবেদিত নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি এবং প্রতিষ্ঠাতা, সেভ দ্য রোড।