ভূ-রাজনীতির বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর

দেলোয়ার এইচ রাইন
২৫ জুলাই, ২০২২, 11:29 PM

ভূ-রাজনীতির বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ। একসময় বিশ্বনেতৃবৃন্দ যে দেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিতে দেখতো সেই দেশটিতে বর্তমানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। বিগত দশকে গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডম্যান স্যাক্স’র একুশ শতকের ‘নেক্সট ১১’ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাত ক্রমবর্ধমান। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর সময়েও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির মোট রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই বিষ্ময়কর উত্থান অপ্রতিরোধ্যগতিতে এগিয়ে চললেও দেশে এখনো পর্যন্ত পণ্য আমদানি রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত সামুদ্রিক অবকাঠামো গড়ে উঠেনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, সামাজিক সূচক ও জনগণের জীবনমানের সামগ্রিক অগ্রগতি অর্জন করলেও দীর্ঘ ৫০ বছরের মধ্যে এখনো নতুন কোন সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারেনি। দেশে যে দুইটি বন্দর রয়েছে চট্টগ্রাম ও মোংলা - এর মাধ্যমেই বছরে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। উভয় বন্দরই বড় কন্টেইনার জাহাজের জন্য খুব অগভীর যার ফলে পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট লাইটার জাহাজে করে খালাস করা হয়। এতে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রিতা। এভাবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাপূর্ন বাজারে বন্দর দু’টির সক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।
বর্তমান আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করে। তবে এই অঞ্চলে অন্যান্য শক্তিশালী কর্মক রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের উদ্যোগ প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে যা বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কোন একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সাথে সমুদ্রবন্দর নিয়ে চুক্তি করা, অন্য কোন রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব আমলে নিয়ে চুক্তি ভেঙ্গে দেওয়া, প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন করা ও প্রকল্পের শর্তে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ যুক্ত করা প্রভৃতি নিয়ে গত এক দশকে যেন এক ধরনের লুকোচুরি খেলা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীন, জাপান এবং ভারতকে একে অপরের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনছে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কৌশলগত সেভেন সিস্টারস বাংলাদেশ দ্বারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের ফানেলের একদম মুখে যা ভারত মহাসাগরের উত্তরদিকে অবস্থিত। এই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের ২৫ শতাংশ ভূমি এবং ৪০ শতাংশ তেল ও গ্যাসের মজুদ। সেই সাথে এই অঞ্চলে রয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষের আবাস। এই সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লাইন যার মাধ্যমে পূর্ব এশিয়াতে মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের সিংহভাগ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাই এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ এই অঞ্চলের অন্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো দিন দিন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে পূর্ব ও পশ্চিমের স্বার্থের অন্যতম খেলার মাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে উদীয়মান বাংলাদেশকে। বাইরের শক্তিগুলো প্রত্যকেই বাংলাদেশকে নিজেদের স্বার্থে টানার চেষ্টা করলেও ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাবের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একটি ‘কী স্টোন নেশন’ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে তা হলো চীন। চীন তাদের বাণিজ্য রুটগুলোকে সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী করার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-র উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সমুদ্রবন্দরসমূহের নেটওয়ার্ক সংবলিত একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রুট বিআরআই প্রকল্পেরই একটি সামুদ্রিক সংস্করণ। এই মেরিটাইম সিল্ক রুট চীনের নিজস্ব উপকূলরেখা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগর, আফ্রিকার পূর্ব উপকূল এবং ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও চীনের পক্ষ থেকে একে একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তারপরেও এটা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্য কর্মক রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। ২০০৫ সালের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে পরামর্শদাতা সংস্থা বুজ অ্যালেন হ্যামিল্টন এই আতঙ্কের কথা তুলে ধরেছিল এবং চীনের আগ্রাসী এই বলয়কে স্ট্রিং অব পার্লস বা মুক্তার মালা নামে অভিহিত করেছিল।
প্রতিবেশী ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্ক থাকায় এই অঞ্চলে মেরিটাইম সিল্ক রূটের অন্যতম এজেন্ডা হলো বাংলাদেশ। যার জন্য বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীন তার বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে এবং একসময় চীন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে চীন ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ প্রতিশ্রুতি। এইসব ঋণের বড় অংশ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা ও নতুন বন্দর নির্মাণে ব্যয় করার জন্য চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব বক্ররেখায় কর্ণফুলী নদীর একটু ওপরে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রাচীন মেরিটাইম সিল্ক রোডের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর টলেমি, চীনা পরিব্রাজক ফা হিউয়ান এবং ইবনে বতুতার লেখায় চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। দেশের প্রাচীনতম এই বন্দরের রয়েছে মোট কনটেইনার কার্গোর ৯৮ শতাংশ এবং মোট কার্গো ভলিউমের ৯২ শতাংশ হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা হলো এর সর্বোচ্চ ড্রাফট মাত্র ৯.২ মিটার যা অধিকাংশ আধুনিক কনটেইনার জাহাজের জন্য যথেষ্ট গভীর নয়। ফলে বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনা। যার জন্য বঙ্গোপসাগরে বহিঃনোঙর করা বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার পতেঙ্গা উপকূলে এবং চট্টগ্রামের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে ১২০০ একর দ্বীপে একটি নতুন বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বে টার্মিনাল নামে পরিচিত এই নতুন বন্দর প্রযুক্তিগতভাবে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না - কারণ এর সর্বোচ্চ ড্রাফট ১৩ বা ১৪ মিটার পর্যন্ত হবে। ১৫ মিটার ড্রাফট বা তার চেয়ে বেশি বড় জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে না পারলেও বেশ বড় বড় জাহাজ অনায়াসে বন্দরে মালামাল পরিবহন করতে সক্ষম হবে।
২০১০ সালের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য চীনকে প্রকাশ্যে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং এক পর্যায়ে দেশটি ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে । মূলত চীনা ঋণে নির্মিত এই অবকাঠামোটি চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে নির্মিত কোন একটি বন্দর পর্যন্ত স্থলপথ করিডোর হিসেবে কাজ করবে যা মায়ানমারকে ট্রানজিট করার পাশাপাশি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় চীনের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়তা করবে। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর প্রস্তাবটিকে চীনের স্ট্রিং অব পার্লস’র একটি ‘মুক্তা’ হিসাবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে অন্য কর্মক রাষ্ট্রগুলোর কাছে নেতিবাচকভাবে প্ররোচিত করে। ফলে সামগ্রিকদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকল্প থেকে ফিরে আসে।
আঞ্ছলিক পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্বে পড়ে চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে বলে চীন বাংলাদেশে আরেকটি গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য একটি আকস্মিক পরিকল্পনা করেছিল। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে দেশের দক্ষিণে কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়া দ্বীপে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে জাপানি জরিপ কার্যক্রম শুরু করে। জরিপের ফলাফলে গভীর বন্দরের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপ চূড়ান্ত হলে চীন এই পরিকল্পনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। উভয় দেশের সম্মতিতে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের বেইজিং সফরের সময় ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে সোনাদিয়ার জন্য একটি চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হতে চলেছে, কিন্তু তখন আর তা সম্ভব হয়নি।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে এক সময় ব্যাপক শোরগোল উঠলেও হঠাৎ করে নিস্থব্ধতা নেমে আসে। কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় যে পরিবেশগত ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে সোনাদিয়া প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। কিন্ত বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন ভিন্ন কথা যা আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখেছি। চীনকে সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনা করতে না দেওয়ার জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়েছিল । চীন ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ এবং মায়ানমারে বন্দর নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ ছিল তাদের স্ট্রিং অব পার্লস’র শেষ অবশিষ্ট সংযোগ যা সম্পূর্ন করতে পারলে এই অঞ্চলকে বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ঘিরে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হতো। স্বভাবতই ভারত বিষয়টি বুঝতে পেরে বাংলাদেশের ওপর নানামুখি চাপ অব্যাহত রাখে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধে ইন্দ্রাণী বাগচি লিখেছিলেন, ‘সোনাদিয়া বাতিল করা স্পষ্টতই বাংলাদেশের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত, নিঃসন্দেহে এতে ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করেছে।’
সোনাদিয়া থেকে চীন প্রত্যাখ্যাত হলে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা তৈরি হয়। এদিকে রয়ে যায় চীনের প্রতিশ্রুত বিপুল পরিমাণ টাকা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার কিছুটা কৌশলী হয়ে দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাস্থ আন্ধারমানিক নদীর উপকণ্ঠ ধরে রাবনাবাদ চ্যানেলের তীর বরাবর পায়রা সমুদ্রবন্দর নামে প্রকল্প গ্রহণ করে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্ল্যাটফর্মে অর্থায়ন করা এই বন্দরটির নির্মাণকাজ মূলত একটি চীনা কোম্পানিকে দেওয়া হয়। চীনারা অনেক জটিলতার পরও প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দায়িত্ব পেয়ে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু এই বন্দর ঘিরে দ্রুতই ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমবেত তৎপরতা শুরু হয়। ভারত একচ্ছত্রভাবে চীনকে গভীর এই বন্দর ব্যবহার করার সুযোগের পরিবর্তে তারাও বিনিয়োগ করতে চায় এবং বন্দর ব্যবহার করতে চায়। পরে বাংলাদেশ একে একটি সমবায় বন্দরে পুনর্গঠন করে। মালিকানার ৩০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি ৭০ শতাংশ উন্মুক্ত করে দেয় দেশী বিদেশি প্রাইভেট বিনিয়োগকারীদের জন্য যেখানে বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ করতে পারবে এবং টার্মিনালগুলো পরিচালনা করতে পারবে। ইতোমধ্যে ভারতীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলো পায়রায় অংশগ্রহণ করছে এবং আরো ১০টি দেশ ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
পায়রা বন্দর নিয়ে এতো সংস্কার হলেও ভারতের আশংকা দূর করতে পারেনি বাংলাদেশ। তারা মনে করে এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে এবং চীনের শক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত হলে প্রতিযোগিতায় নেমে চীনকে হঠানো একসময় ভারতের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। সেই আশংকার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশে জোড়ালো কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে ভারত। ক্ষমতার রাজনীতিতে উভয়দেশের পারষ্পারিক আস্থা ও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকায় আঞ্চলিক স্বার্থের সাথে জড়িত যেকোন ইস্যুতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। যদিও এই প্রভাব অনেকটা একতরফা তবে অন্যান্য পারষ্পারিক স্বার্থের বৈচিত্রের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
অবশেষে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন আর্থিক দিক থেকে লাভবান না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচের সম্ভাবনা ছাড়াও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হওয়ায় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তা সরকার বাদ দিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন, ‘পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ছিলো একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর চেষ্টা হয়েছিলো। এটি কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর হতো না। বরং বন্দর হিসেবে এটি মংলার চেয়ে ভালো হবে।’
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর না হলেও এটা সাধারণ সমুদ্রবন্দর হিসেবে চালু থাকবে। ইতোমধ্যে এ বন্দরকে ঘিরে সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে এবং বন্দরের বাকি কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশে কি আর কখনোই কোন গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না? এই প্রশ্নের সমাধানে ও বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের স্বাদ দিতে এগিয়ে আসে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ২০১৪ সালে এশীয় অঞ্চল থেকে জাপানের সাথে বাংলাদেশও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদের জন্য প্রতদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ঠিক তার আগে বাংলাদেশে উড়ে আসেন শিনজো আবে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেন যে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের পদটি জাপানের জন্য ছেড়ে দিতে এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জাপান এ অঞ্চলে বিশাল বিনিয়োগ করতে চায়। এ প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজী হলে জাপান নিয়ে আসে ‘বিগ বি’ ধারণা, যা হলো ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’। এ কৌশলগত পরিকল্পনায় এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, শিল্পাঞ্চলসহ সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ‘বিগ বি’ উদ্যোগের ঘোষণা দেন। এর বাস্তব রূপ দিতে দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ২০১৬ সালে একটি জরিপ করে মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দেয়। জাইকা একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল, চারটি ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি রেললাইন, সড়কপথ এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সাথে একটি স্মারক অবকাঠামোগত প্যাকেজের অংশ হিসাবে বন্দরটি নির্মাণ করবে। কার্যত এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রকল্প পরিকল্পনা বলছে, এই বন্দরের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের বেল্ট এন্ড রোড এ যোগ দিলেও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে একধরনের ব্যালেন্সিং সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ কে সামনে রেখে প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ যে আজ তার মূল অবস্থানকে কাজে লাগাতে চায় একথা পরিষ্কার। অদূর ভবিষত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্ভাব্য সেতুবন্ধনকারী এই ভূ-খন্ডের প্রতিটি দিগন্তে ভূ-রাজনীতির নাটকীয় খেলায় বাংলাদেশ কেমন পারফর্ম করে সেটাই দেখার বিষয়।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ, সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি
দেলোয়ার এইচ রাইন
২৫ জুলাই, ২০২২, 11:29 PM

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ। একসময় বিশ্বনেতৃবৃন্দ যে দেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিতে দেখতো সেই দেশটিতে বর্তমানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। বিগত দশকে গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডম্যান স্যাক্স’র একুশ শতকের ‘নেক্সট ১১’ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাত ক্রমবর্ধমান। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর সময়েও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির মোট রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই বিষ্ময়কর উত্থান অপ্রতিরোধ্যগতিতে এগিয়ে চললেও দেশে এখনো পর্যন্ত পণ্য আমদানি রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত সামুদ্রিক অবকাঠামো গড়ে উঠেনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, সামাজিক সূচক ও জনগণের জীবনমানের সামগ্রিক অগ্রগতি অর্জন করলেও দীর্ঘ ৫০ বছরের মধ্যে এখনো নতুন কোন সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারেনি। দেশে যে দুইটি বন্দর রয়েছে চট্টগ্রাম ও মোংলা - এর মাধ্যমেই বছরে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। উভয় বন্দরই বড় কন্টেইনার জাহাজের জন্য খুব অগভীর যার ফলে পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট লাইটার জাহাজে করে খালাস করা হয়। এতে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রিতা। এভাবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাপূর্ন বাজারে বন্দর দু’টির সক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।
বর্তমান আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করে। তবে এই অঞ্চলে অন্যান্য শক্তিশালী কর্মক রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের উদ্যোগ প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে যা বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কোন একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সাথে সমুদ্রবন্দর নিয়ে চুক্তি করা, অন্য কোন রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব আমলে নিয়ে চুক্তি ভেঙ্গে দেওয়া, প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন করা ও প্রকল্পের শর্তে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ যুক্ত করা প্রভৃতি নিয়ে গত এক দশকে যেন এক ধরনের লুকোচুরি খেলা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীন, জাপান এবং ভারতকে একে অপরের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনছে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কৌশলগত সেভেন সিস্টারস বাংলাদেশ দ্বারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের ফানেলের একদম মুখে যা ভারত মহাসাগরের উত্তরদিকে অবস্থিত। এই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের ২৫ শতাংশ ভূমি এবং ৪০ শতাংশ তেল ও গ্যাসের মজুদ। সেই সাথে এই অঞ্চলে রয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষের আবাস। এই সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লাইন যার মাধ্যমে পূর্ব এশিয়াতে মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের সিংহভাগ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাই এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ এই অঞ্চলের অন্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো দিন দিন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে পূর্ব ও পশ্চিমের স্বার্থের অন্যতম খেলার মাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে উদীয়মান বাংলাদেশকে। বাইরের শক্তিগুলো প্রত্যকেই বাংলাদেশকে নিজেদের স্বার্থে টানার চেষ্টা করলেও ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাবের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একটি ‘কী স্টোন নেশন’ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে তা হলো চীন। চীন তাদের বাণিজ্য রুটগুলোকে সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী করার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-র উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সমুদ্রবন্দরসমূহের নেটওয়ার্ক সংবলিত একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রুট বিআরআই প্রকল্পেরই একটি সামুদ্রিক সংস্করণ। এই মেরিটাইম সিল্ক রুট চীনের নিজস্ব উপকূলরেখা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগর, আফ্রিকার পূর্ব উপকূল এবং ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও চীনের পক্ষ থেকে একে একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তারপরেও এটা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্য কর্মক রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। ২০০৫ সালের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে পরামর্শদাতা সংস্থা বুজ অ্যালেন হ্যামিল্টন এই আতঙ্কের কথা তুলে ধরেছিল এবং চীনের আগ্রাসী এই বলয়কে স্ট্রিং অব পার্লস বা মুক্তার মালা নামে অভিহিত করেছিল।
প্রতিবেশী ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্ক থাকায় এই অঞ্চলে মেরিটাইম সিল্ক রূটের অন্যতম এজেন্ডা হলো বাংলাদেশ। যার জন্য বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীন তার বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে এবং একসময় চীন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে চীন ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ প্রতিশ্রুতি। এইসব ঋণের বড় অংশ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা ও নতুন বন্দর নির্মাণে ব্যয় করার জন্য চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব বক্ররেখায় কর্ণফুলী নদীর একটু ওপরে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রাচীন মেরিটাইম সিল্ক রোডের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর টলেমি, চীনা পরিব্রাজক ফা হিউয়ান এবং ইবনে বতুতার লেখায় চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ রয়েছে। দেশের প্রাচীনতম এই বন্দরের রয়েছে মোট কনটেইনার কার্গোর ৯৮ শতাংশ এবং মোট কার্গো ভলিউমের ৯২ শতাংশ হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা হলো এর সর্বোচ্চ ড্রাফট মাত্র ৯.২ মিটার যা অধিকাংশ আধুনিক কনটেইনার জাহাজের জন্য যথেষ্ট গভীর নয়। ফলে বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনা। যার জন্য বঙ্গোপসাগরে বহিঃনোঙর করা বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার পতেঙ্গা উপকূলে এবং চট্টগ্রামের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে ১২০০ একর দ্বীপে একটি নতুন বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বে টার্মিনাল নামে পরিচিত এই নতুন বন্দর প্রযুক্তিগতভাবে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না - কারণ এর সর্বোচ্চ ড্রাফট ১৩ বা ১৪ মিটার পর্যন্ত হবে। ১৫ মিটার ড্রাফট বা তার চেয়ে বেশি বড় জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে না পারলেও বেশ বড় বড় জাহাজ অনায়াসে বন্দরে মালামাল পরিবহন করতে সক্ষম হবে।
২০১০ সালের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য চীনকে প্রকাশ্যে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং এক পর্যায়ে দেশটি ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে । মূলত চীনা ঋণে নির্মিত এই অবকাঠামোটি চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে নির্মিত কোন একটি বন্দর পর্যন্ত স্থলপথ করিডোর হিসেবে কাজ করবে যা মায়ানমারকে ট্রানজিট করার পাশাপাশি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় চীনের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়তা করবে। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর প্রস্তাবটিকে চীনের স্ট্রিং অব পার্লস’র একটি ‘মুক্তা’ হিসাবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে অন্য কর্মক রাষ্ট্রগুলোর কাছে নেতিবাচকভাবে প্ররোচিত করে। ফলে সামগ্রিকদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকল্প থেকে ফিরে আসে।
আঞ্ছলিক পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্বে পড়ে চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে বলে চীন বাংলাদেশে আরেকটি গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য একটি আকস্মিক পরিকল্পনা করেছিল। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে দেশের দক্ষিণে কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়া দ্বীপে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে জাপানি জরিপ কার্যক্রম শুরু করে। জরিপের ফলাফলে গভীর বন্দরের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপ চূড়ান্ত হলে চীন এই পরিকল্পনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। উভয় দেশের সম্মতিতে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের বেইজিং সফরের সময় ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে সোনাদিয়ার জন্য একটি চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হতে চলেছে, কিন্তু তখন আর তা সম্ভব হয়নি।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে এক সময় ব্যাপক শোরগোল উঠলেও হঠাৎ করে নিস্থব্ধতা নেমে আসে। কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় যে পরিবেশগত ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে সোনাদিয়া প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। কিন্ত বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন ভিন্ন কথা যা আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখেছি। চীনকে সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনা করতে না দেওয়ার জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়েছিল । চীন ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ এবং মায়ানমারে বন্দর নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ ছিল তাদের স্ট্রিং অব পার্লস’র শেষ অবশিষ্ট সংযোগ যা সম্পূর্ন করতে পারলে এই অঞ্চলকে বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ঘিরে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হতো। স্বভাবতই ভারত বিষয়টি বুঝতে পেরে বাংলাদেশের ওপর নানামুখি চাপ অব্যাহত রাখে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধে ইন্দ্রাণী বাগচি লিখেছিলেন, ‘সোনাদিয়া বাতিল করা স্পষ্টতই বাংলাদেশের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত, নিঃসন্দেহে এতে ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করেছে।’
সোনাদিয়া থেকে চীন প্রত্যাখ্যাত হলে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা তৈরি হয়। এদিকে রয়ে যায় চীনের প্রতিশ্রুত বিপুল পরিমাণ টাকা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার কিছুটা কৌশলী হয়ে দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাস্থ আন্ধারমানিক নদীর উপকণ্ঠ ধরে রাবনাবাদ চ্যানেলের তীর বরাবর পায়রা সমুদ্রবন্দর নামে প্রকল্প গ্রহণ করে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্ল্যাটফর্মে অর্থায়ন করা এই বন্দরটির নির্মাণকাজ মূলত একটি চীনা কোম্পানিকে দেওয়া হয়। চীনারা অনেক জটিলতার পরও প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দায়িত্ব পেয়ে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু এই বন্দর ঘিরে দ্রুতই ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমবেত তৎপরতা শুরু হয়। ভারত একচ্ছত্রভাবে চীনকে গভীর এই বন্দর ব্যবহার করার সুযোগের পরিবর্তে তারাও বিনিয়োগ করতে চায় এবং বন্দর ব্যবহার করতে চায়। পরে বাংলাদেশ একে একটি সমবায় বন্দরে পুনর্গঠন করে। মালিকানার ৩০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি ৭০ শতাংশ উন্মুক্ত করে দেয় দেশী বিদেশি প্রাইভেট বিনিয়োগকারীদের জন্য যেখানে বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ করতে পারবে এবং টার্মিনালগুলো পরিচালনা করতে পারবে। ইতোমধ্যে ভারতীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলো পায়রায় অংশগ্রহণ করছে এবং আরো ১০টি দেশ ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
পায়রা বন্দর নিয়ে এতো সংস্কার হলেও ভারতের আশংকা দূর করতে পারেনি বাংলাদেশ। তারা মনে করে এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে এবং চীনের শক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত হলে প্রতিযোগিতায় নেমে চীনকে হঠানো একসময় ভারতের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। সেই আশংকার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশে জোড়ালো কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে ভারত। ক্ষমতার রাজনীতিতে উভয়দেশের পারষ্পারিক আস্থা ও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকায় আঞ্চলিক স্বার্থের সাথে জড়িত যেকোন ইস্যুতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। যদিও এই প্রভাব অনেকটা একতরফা তবে অন্যান্য পারষ্পারিক স্বার্থের বৈচিত্রের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
অবশেষে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন আর্থিক দিক থেকে লাভবান না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচের সম্ভাবনা ছাড়াও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হওয়ায় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তা সরকার বাদ দিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন, ‘পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ছিলো একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর চেষ্টা হয়েছিলো। এটি কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর হতো না। বরং বন্দর হিসেবে এটি মংলার চেয়ে ভালো হবে।’
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর না হলেও এটা সাধারণ সমুদ্রবন্দর হিসেবে চালু থাকবে। ইতোমধ্যে এ বন্দরকে ঘিরে সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে এবং বন্দরের বাকি কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশে কি আর কখনোই কোন গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না? এই প্রশ্নের সমাধানে ও বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের স্বাদ দিতে এগিয়ে আসে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ২০১৪ সালে এশীয় অঞ্চল থেকে জাপানের সাথে বাংলাদেশও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদের জন্য প্রতদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ঠিক তার আগে বাংলাদেশে উড়ে আসেন শিনজো আবে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেন যে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যের পদটি জাপানের জন্য ছেড়ে দিতে এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জাপান এ অঞ্চলে বিশাল বিনিয়োগ করতে চায়। এ প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজী হলে জাপান নিয়ে আসে ‘বিগ বি’ ধারণা, যা হলো ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’। এ কৌশলগত পরিকল্পনায় এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, শিল্পাঞ্চলসহ সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ‘বিগ বি’ উদ্যোগের ঘোষণা দেন। এর বাস্তব রূপ দিতে দেশটির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ২০১৬ সালে একটি জরিপ করে মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণের পরামর্শ দেয়। জাইকা একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল, চারটি ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি রেললাইন, সড়কপথ এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার সাথে একটি স্মারক অবকাঠামোগত প্যাকেজের অংশ হিসাবে বন্দরটি নির্মাণ করবে। কার্যত এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রকল্প পরিকল্পনা বলছে, এই বন্দরের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের বেল্ট এন্ড রোড এ যোগ দিলেও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে একধরনের ব্যালেন্সিং সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ কে সামনে রেখে প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ যে আজ তার মূল অবস্থানকে কাজে লাগাতে চায় একথা পরিষ্কার। অদূর ভবিষত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্ভাব্য সেতুবন্ধনকারী এই ভূ-খন্ডের প্রতিটি দিগন্তে ভূ-রাজনীতির নাটকীয় খেলায় বাংলাদেশ কেমন পারফর্ম করে সেটাই দেখার বিষয়।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ, সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি