শিরোনামঃ
‘বাবা নেই’ ভিডিও গানের মোড়ক উন্মোচন আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষে থাকবে ইমপিরিয়াল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাতার মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশ জনতা পার্টির আলোচনা সভা রহিম আল-হুসাইনি আগা খান পঞ্চম-এর অভিষেক অনুষ্ঠিত আগা খান ৪র্থ আসওয়ান ,মিশরে শায়িত হলেন শিয়া ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম আগা খানের জানাজা অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাজারের ক্রয়কৃত দোকান দখল, থানায় অভিযোগ আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়নে তথ্য অধিকার আইন চর্চার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে: উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

গণতন্ত্রায়ণের স্বার্থে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার প্রয়োজন

#
news image

গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার কী ও কেন: স্থানীয় মানুষের সেবা ও উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিটে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে যে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থা থাকে তাকেই স্থানীয় সরকার বলে। নিয়ম অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার নিজস্ব আয় দ্বারা প্রথমে শতভাগ সিস্টেম কষ্ট তথা দাপ্তরিক খরচ, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, আপ্যায়ন ব্যয় ইত্যাদি নির্বাহ করবে এবং একই সঙ্গে নিজস্ব উদ্বৃত্ত আয়ে ও প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে নিজস্ব এলাকায় সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। তাই বলা যায়, স্থানীয় সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া মানেই গোটা দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং স্থানীয় সেবা ও উন্নয়ন মানেই সমগ্র দেশের সমষ্টিগত সেবা ও উন্নয়ন সেবা নিশ্চিত হওয়া। 
ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রথমে স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় শাসন এসেছে। তারপর তারা জাতীয় রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যে বিস্তার করাতে সক্ষম হয়। এ দেশেও পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র ছিল। এ দেশের সীমান্তগুলো ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মতো দুর্গম না হওয়ায় বিদেশিরা খুব সহজে বারবার আক্রমণ করে দেশটিকে দখলে নিয়েছে। ফলে এ দেশে স্থানীয় শাসন কাঠামো স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। আমাদের সমাজ হাজার হাজার বছর যাবৎ গ্রামীণ সমাজ ছিল। আমাদের নামকরা কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের  লেখায় গ্রামীণ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।বর্তমান দেশটিকে আর গ্রামীণ দেশ বলা যায় না; বলা উচিত গ্রামীণ-নগরীয় অবস্থার দেশ। গবেষকদের মতে, আগামী ২০৫০ সালের আগে কিংবা পরে সমগ্র দেশের জনগণ নগরীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। তখন নগরীয় কৃষি, নগরীয় খাদ্যভ্যাস, নগরীয় আচার-আচরণ, নগরীয় আইন-কানুন সহ বহু কিছু প্রয়োজনের স্বার্থে চলে আসবে। 
দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই গতিশীল সমাজকে ধারণ করে উপযুক্ত রাজনীতি ও শাসন কাঠামো নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা খুব কমই  লক্ষ্য করা যায়। তবে বর্তমান সরকার ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু সেটা ‘আপ-টু-বটম’ পদ্ধতির আধুনিকায়ন মাত্র; স্থানীয়দের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগরায়নের উদ্দেশ্যে নয়। আসার কথা, একটি প্রস্তাবিত ডিজাইন নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বাস্তবায়নের স্বার্থে গত ২০০৮ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ‘সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক লোকাল গভর্ন্যান্স (সিডিএলজি)’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিডিএলজি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এই রূপরেখাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল স্থানীয় স্তরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থানীয়করণ অর্থাৎ প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশকে গণতন্ত্রায়নের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সরকারের নামকরণ ও প্রকারভেদকরণ: বাংলাদেশে বর্তমানে একটিই সরকার, তা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। একটি মাত্র সরকার থাকায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হওয়া সঠিক নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ‘স্থানীয় সরকার’ নামে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এগুলো বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্থানীয় এজেন্ট বা শাখা হিসেবে কাজ করছে; এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নয় বলে তাদের পরিবর্তে সকল স্থানীয় স্তরে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গঠন করতে হবে। 
সংবিধানে ‘স্থানীয় শাসন-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং আইন, বিধি-বিধান ও বই-পুস্তকের যেসব জায়গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বোঝাতে শুধু ‘সরকার শব্দটি রয়েছে সেসব জায়গায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপন করতে হবে; সেসঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি যুক্ত করে (যেমন- ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি) তথা প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে।তা করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে দুই প্রকারের সরকার, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব আইনত প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্থানীয় ইউনিট অথবা স্থানীয় সরকারের প্রকারভেদকরণ: বর্তমানে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৯২টি উপজেলা, ৩২৯টি পৌরসভা, ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ৪৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব স্থানীয় ইউনিটগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (১) গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৪,৫৭১টি ইউনিয়ন এবং ১৬৩টি উপজেলা, কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত; (২) নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি নগর করপোরেশন, কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে শুধু নগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত; এবং (৩) গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা ও ৩২৮টি উপজেলা, কারণ এসব ইউনিট গ্রামীণ ও নগরীয় এলাকার সমন্বয়ে গঠিত। 
সাধারণত গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ স্থানীয় সরকার’, নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘নগরীয় স্থানীয় সরকার’ এবং একইভাবে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার’। কিন্তু সরকারি বিধি-বিধান ও পাঠ্যপুস্তকে দুই প্রকারের স্থানীয় সরকার, তথা গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের কথা উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ ৩২৮টি উপজেলা ও ৬৪টি জেলার আয়তনের মধ্যে ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। 
উপজেলার আয়তনের মধ্যে বসবাসরত ভোটারদের ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন। আর জেলার আয়তনের মধ্যে স্থানীয় প্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। সে মোতাবেক জেলা ও উপজেলাগুলো গ্রামীণ-নগরীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে স্থানীয় ইউনিটের নামকরণ যথার্থভাবে করা হয়নি বলে প্রকারভেদকরণও যথার্থভাবে করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথার্থভাবে নির্ধারণ ও বণ্টন করা যাচ্ছে না।
প্রস্তাবিত একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ: স্থানীয় সরকার এক স্তরবিশিষ্ট হলে স্তরবিন্যাসকরণের বিষয়টি কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতো না। এটি বহু স্তরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটিকে একটি তত্ত্বগত ফর্মুলায় বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করতে হবে, যা মুঘল-পূর্ব, মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলে অদ্যাবধি করা সম্ভব হয়নি। তত্ত্বগতভাবে প্রস্তাবিত ডিজাইন অনুযায়ী ‘জেলা’ গ্রামীণ-নগরীয় চরিত্র নিয়ে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হতে পারে। 
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার হিসেবে ‘জেলা সরকার’ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তার একদিকে থাকবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার অর্থাৎ উপজেলা সরকার (যদি প্রয়োজনীয়তা থাকে) ও ইউনিয়ন সরকার এবং অন্যদিকে থাকবে নগরীয় স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলো। এ ক্ষেত্রে শুধু ইউনিয়ন নয়, উপজেলার এলাকার মধ্যে কোনো নগরীয় এলাকা (পৌরসভা) থাকবে না; তাতে ইউনিয়ন ও উপজেলা সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ ইউনিট হবে। পৌরসভা ও নগর করপোরেশনগুলো শুধু নগর হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং সেখানে এক ধরনের নগরীয় স্থানীয় সরকার থাকবে, তা করতে গিয়ে বর্তমানে দুই ধরনের নাম, দুই ধরনের আইন ও দুই ধরনের ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় বলে বিলুপ্ত হবে। 
এখানে লক্ষণীয় যে, নগরের আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ইউনিটগুলোর আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা কমতে থাকবে। গোটা বাংলাদেশ নগরে পরিণত হয়ে যাওয়ার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামীণ ইউনিটগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে; ফলে বাংলাদেশ অনেকগুলো নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে; তখন স্থানীয় সরকার দুই স্তরবিশিষ্ট-জেলা সরকার ও নগর সরকার হয়ে যাবে; এবং বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট তথা কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার ও নগর সরকার-হওয়ার মাধ্যমে সরকারের আকার-আয়তন ছোট হয়ে পড়বে। তাই প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাসটি খুবই গতিশীল ও সুদূরপ্রসারী। এটি গ্রহণ করে দ্রুত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলে প্রতীয়মান হয়।
স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট-ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার: স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট যথার্থভাবে নির্ধারিত না হওয়ায় এক ধরনের মারাত্মক ধারণাগত বিভ্রান্তি বিরাজমান রয়েছে। পূর্বে ইউনিয়নের নিচে অন্য কোনো ইউনিটকে (গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা ইত্যাদি) স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হতো এবং বর্তমানে ইউনিয়নকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হয়। কেউ কেউ পৌরসভাকে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করেন (এখানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও কতিপয় স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞের প্রদর্শিত রেখচিত্র উদাহরণ হতে পারে)। তারা যুক্তি দেখান, যেহেতু ইউনিয়ন উপজেলার অধীনে ঠিক নিচে অবস্থান করছে সেজন্য ইউনিয়ন হলো গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট। 
যদি তাদেরকে পালটা প্রশ্ন করা যায়, পৌরসভাগুলো কি সিটি করপোরেশনগুলোর অধীনে আছে? সে ক্ষেত্রে তাদের নিকট থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট একটি নয়; সর্বনিম্ন ইউনিট হতে হবে দুটি ইউনিয়ন ও নগর (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন), অর্থাৎ ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার। নগর বলতে দেশের ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন ও নগর পাশাপাশি অবস্থিত দুটি স্থানীয় ইউনিট এবং ভৌগোলিকভাবে পৃথক ও ভিন্ন ধরনের দুটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট। তাই স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে একদিকে গ্রামীণ এলাকায় থাকবে ইউনিয়ন সরকার এবং অপরদিকে নগরীয় এলাকায় থাকবে নগর সরকারগুলো। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত ইউনিয়ন সরকারের রূপরেখা ও নগর সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় অবশ্যই গঠন করতে হবে। 
গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়নের নিচে আর কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও অতীতে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা, গ্রাম পরিষদ, গ্রাম সরকার ইত্যাদি নামে আরেকটি স্থানীয় সরকার ইউনিট স্থাপন করা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা ও মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে এবং তা করতে গিয়ে ইউনিয়নকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অথচ তারা ভেবে দেখেননি, ইউনিয়ন কার্যকর হওয়া মানেই গ্রাম, পাড়া ও ওয়ার্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া। আবার স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) গঠন ও কার্যকর করার ওপর জোর না দিয়ে মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে উপজেলার ওপর অতিমাত্রায় জোর দিতে গিয়েও ইউনিয়নকে অবহেলিত ও দুর্বলতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্তমানে ‘ওয়ার্ড সভা’ নামে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় স্তর কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের স্বার্থে এসব অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে হয়। তাই আমাদেরকে ‘ইউনিয়নে ইউনিয়নে গণতন্ত্রায়ন, ইউনিয়নের জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘নগরে নগরে গণতন্ত্রায়ন, নগরের জনগণের ক্ষমতায়ন’ শ্লোগানদ্বয়ের ভিতরগত তাৎপর্য উপলব্ধি করে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হতে হবে।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক এবং সদস্য, সিডিএলজি।

মোশাররফ হোসেন মুসা

০৩ আগস্ট, ২০২২,  11:22 PM

news image

গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার কী ও কেন: স্থানীয় মানুষের সেবা ও উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিটে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে যে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থা থাকে তাকেই স্থানীয় সরকার বলে। নিয়ম অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার নিজস্ব আয় দ্বারা প্রথমে শতভাগ সিস্টেম কষ্ট তথা দাপ্তরিক খরচ, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, আপ্যায়ন ব্যয় ইত্যাদি নির্বাহ করবে এবং একই সঙ্গে নিজস্ব উদ্বৃত্ত আয়ে ও প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে নিজস্ব এলাকায় সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। তাই বলা যায়, স্থানীয় সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া মানেই গোটা দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং স্থানীয় সেবা ও উন্নয়ন মানেই সমগ্র দেশের সমষ্টিগত সেবা ও উন্নয়ন সেবা নিশ্চিত হওয়া। 
ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রথমে স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় শাসন এসেছে। তারপর তারা জাতীয় রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যে বিস্তার করাতে সক্ষম হয়। এ দেশেও পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র ছিল। এ দেশের সীমান্তগুলো ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মতো দুর্গম না হওয়ায় বিদেশিরা খুব সহজে বারবার আক্রমণ করে দেশটিকে দখলে নিয়েছে। ফলে এ দেশে স্থানীয় শাসন কাঠামো স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। আমাদের সমাজ হাজার হাজার বছর যাবৎ গ্রামীণ সমাজ ছিল। আমাদের নামকরা কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের  লেখায় গ্রামীণ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।বর্তমান দেশটিকে আর গ্রামীণ দেশ বলা যায় না; বলা উচিত গ্রামীণ-নগরীয় অবস্থার দেশ। গবেষকদের মতে, আগামী ২০৫০ সালের আগে কিংবা পরে সমগ্র দেশের জনগণ নগরীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। তখন নগরীয় কৃষি, নগরীয় খাদ্যভ্যাস, নগরীয় আচার-আচরণ, নগরীয় আইন-কানুন সহ বহু কিছু প্রয়োজনের স্বার্থে চলে আসবে। 
দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই গতিশীল সমাজকে ধারণ করে উপযুক্ত রাজনীতি ও শাসন কাঠামো নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা খুব কমই  লক্ষ্য করা যায়। তবে বর্তমান সরকার ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু সেটা ‘আপ-টু-বটম’ পদ্ধতির আধুনিকায়ন মাত্র; স্থানীয়দের মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগরায়নের উদ্দেশ্যে নয়। আসার কথা, একটি প্রস্তাবিত ডিজাইন নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বাস্তবায়নের স্বার্থে গত ২০০৮ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ‘সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক লোকাল গভর্ন্যান্স (সিডিএলজি)’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিডিএলজি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এই রূপরেখাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল স্থানীয় স্তরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থানীয়করণ অর্থাৎ প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশকে গণতন্ত্রায়নের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সরকারের নামকরণ ও প্রকারভেদকরণ: বাংলাদেশে বর্তমানে একটিই সরকার, তা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। একটি মাত্র সরকার থাকায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হওয়া সঠিক নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ‘স্থানীয় সরকার’ নামে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এগুলো বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্থানীয় এজেন্ট বা শাখা হিসেবে কাজ করছে; এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নয় বলে তাদের পরিবর্তে সকল স্থানীয় স্তরে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গঠন করতে হবে। 
সংবিধানে ‘স্থানীয় শাসন-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং আইন, বিধি-বিধান ও বই-পুস্তকের যেসব জায়গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বোঝাতে শুধু ‘সরকার শব্দটি রয়েছে সেসব জায়গায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপন করতে হবে; সেসঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি যুক্ত করে (যেমন- ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি) তথা প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে।তা করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে দুই প্রকারের সরকার, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব আইনত প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্থানীয় ইউনিট অথবা স্থানীয় সরকারের প্রকারভেদকরণ: বর্তমানে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৯২টি উপজেলা, ৩২৯টি পৌরসভা, ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ৪৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব স্থানীয় ইউনিটগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (১) গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৪,৫৭১টি ইউনিয়ন এবং ১৬৩টি উপজেলা, কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত; (২) নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি নগর করপোরেশন, কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে শুধু নগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত; এবং (৩) গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা ও ৩২৮টি উপজেলা, কারণ এসব ইউনিট গ্রামীণ ও নগরীয় এলাকার সমন্বয়ে গঠিত। 
সাধারণত গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ স্থানীয় সরকার’, নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘নগরীয় স্থানীয় সরকার’ এবং একইভাবে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার’। কিন্তু সরকারি বিধি-বিধান ও পাঠ্যপুস্তকে দুই প্রকারের স্থানীয় সরকার, তথা গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের কথা উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ ৩২৮টি উপজেলা ও ৬৪টি জেলার আয়তনের মধ্যে ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। 
উপজেলার আয়তনের মধ্যে বসবাসরত ভোটারদের ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন। আর জেলার আয়তনের মধ্যে স্থানীয় প্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। সে মোতাবেক জেলা ও উপজেলাগুলো গ্রামীণ-নগরীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে স্থানীয় ইউনিটের নামকরণ যথার্থভাবে করা হয়নি বলে প্রকারভেদকরণও যথার্থভাবে করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথার্থভাবে নির্ধারণ ও বণ্টন করা যাচ্ছে না।
প্রস্তাবিত একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ: স্থানীয় সরকার এক স্তরবিশিষ্ট হলে স্তরবিন্যাসকরণের বিষয়টি কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতো না। এটি বহু স্তরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটিকে একটি তত্ত্বগত ফর্মুলায় বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করতে হবে, যা মুঘল-পূর্ব, মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলে অদ্যাবধি করা সম্ভব হয়নি। তত্ত্বগতভাবে প্রস্তাবিত ডিজাইন অনুযায়ী ‘জেলা’ গ্রামীণ-নগরীয় চরিত্র নিয়ে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হতে পারে। 
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার হিসেবে ‘জেলা সরকার’ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তার একদিকে থাকবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার অর্থাৎ উপজেলা সরকার (যদি প্রয়োজনীয়তা থাকে) ও ইউনিয়ন সরকার এবং অন্যদিকে থাকবে নগরীয় স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলো। এ ক্ষেত্রে শুধু ইউনিয়ন নয়, উপজেলার এলাকার মধ্যে কোনো নগরীয় এলাকা (পৌরসভা) থাকবে না; তাতে ইউনিয়ন ও উপজেলা সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ ইউনিট হবে। পৌরসভা ও নগর করপোরেশনগুলো শুধু নগর হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং সেখানে এক ধরনের নগরীয় স্থানীয় সরকার থাকবে, তা করতে গিয়ে বর্তমানে দুই ধরনের নাম, দুই ধরনের আইন ও দুই ধরনের ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় বলে বিলুপ্ত হবে। 
এখানে লক্ষণীয় যে, নগরের আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ইউনিটগুলোর আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা কমতে থাকবে। গোটা বাংলাদেশ নগরে পরিণত হয়ে যাওয়ার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামীণ ইউনিটগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে; ফলে বাংলাদেশ অনেকগুলো নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে; তখন স্থানীয় সরকার দুই স্তরবিশিষ্ট-জেলা সরকার ও নগর সরকার হয়ে যাবে; এবং বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট তথা কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার ও নগর সরকার-হওয়ার মাধ্যমে সরকারের আকার-আয়তন ছোট হয়ে পড়বে। তাই প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাসটি খুবই গতিশীল ও সুদূরপ্রসারী। এটি গ্রহণ করে দ্রুত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলে প্রতীয়মান হয়।
স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট-ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার: স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট যথার্থভাবে নির্ধারিত না হওয়ায় এক ধরনের মারাত্মক ধারণাগত বিভ্রান্তি বিরাজমান রয়েছে। পূর্বে ইউনিয়নের নিচে অন্য কোনো ইউনিটকে (গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা ইত্যাদি) স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হতো এবং বর্তমানে ইউনিয়নকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হয়। কেউ কেউ পৌরসভাকে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করেন (এখানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও কতিপয় স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞের প্রদর্শিত রেখচিত্র উদাহরণ হতে পারে)। তারা যুক্তি দেখান, যেহেতু ইউনিয়ন উপজেলার অধীনে ঠিক নিচে অবস্থান করছে সেজন্য ইউনিয়ন হলো গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট। 
যদি তাদেরকে পালটা প্রশ্ন করা যায়, পৌরসভাগুলো কি সিটি করপোরেশনগুলোর অধীনে আছে? সে ক্ষেত্রে তাদের নিকট থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট একটি নয়; সর্বনিম্ন ইউনিট হতে হবে দুটি ইউনিয়ন ও নগর (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন), অর্থাৎ ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার। নগর বলতে দেশের ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন ও নগর পাশাপাশি অবস্থিত দুটি স্থানীয় ইউনিট এবং ভৌগোলিকভাবে পৃথক ও ভিন্ন ধরনের দুটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট। তাই স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে একদিকে গ্রামীণ এলাকায় থাকবে ইউনিয়ন সরকার এবং অপরদিকে নগরীয় এলাকায় থাকবে নগর সরকারগুলো। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত ইউনিয়ন সরকারের রূপরেখা ও নগর সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় অবশ্যই গঠন করতে হবে। 
গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়নের নিচে আর কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও অতীতে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা, গ্রাম পরিষদ, গ্রাম সরকার ইত্যাদি নামে আরেকটি স্থানীয় সরকার ইউনিট স্থাপন করা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা ও মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে এবং তা করতে গিয়ে ইউনিয়নকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অথচ তারা ভেবে দেখেননি, ইউনিয়ন কার্যকর হওয়া মানেই গ্রাম, পাড়া ও ওয়ার্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া। আবার স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) গঠন ও কার্যকর করার ওপর জোর না দিয়ে মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে উপজেলার ওপর অতিমাত্রায় জোর দিতে গিয়েও ইউনিয়নকে অবহেলিত ও দুর্বলতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্তমানে ‘ওয়ার্ড সভা’ নামে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় স্তর কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের স্বার্থে এসব অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে হয়। তাই আমাদেরকে ‘ইউনিয়নে ইউনিয়নে গণতন্ত্রায়ন, ইউনিয়নের জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘নগরে নগরে গণতন্ত্রায়ন, নগরের জনগণের ক্ষমতায়ন’ শ্লোগানদ্বয়ের ভিতরগত তাৎপর্য উপলব্ধি করে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হতে হবে।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক এবং সদস্য, সিডিএলজি।