শিরোনামঃ
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে প্রবাসীর বাসা দখলের চেষ্টা , অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি ‘বাবা নেই’ ভিডিও গানের মোড়ক উন্মোচন আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষে থাকবে ইমপিরিয়াল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠাতার মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দেশ জনতা পার্টির আলোচনা সভা রহিম আল-হুসাইনি আগা খান পঞ্চম-এর অভিষেক অনুষ্ঠিত আগা খান ৪র্থ আসওয়ান ,মিশরে শায়িত হলেন শিয়া ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম আগা খানের জানাজা অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাজারের ক্রয়কৃত দোকান দখল, থানায় অভিযোগ আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনো সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের শেষ কোথায়?

#
news image

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, যে দেশের মানুষ যত শিক্ষিত সে দেশ তত উন্নত। বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাডেমিক ভবণ, রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ মানসম্মত উন্নত পাঠদান নিশ্চিত করতে নানাম‚খি উদ্দ্যেগ গ্রহন করেছেন। কিন্তু একটি কুচক্রীমহ সরকারের সুনাম, উন্নয়ন নষ্ট করে দিচ্ছেন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর থেকে আরো কঠোর হতে হবে। সে যে দলের, মতের হউক না কেন? কোনভাবে ছাড় দেয়া যাবে না। 
প্রশ্ন ফাঁসের নিউজটি পড়তে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকগণ জড়িত। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সন্দেহের তালিকায় কমিটির সব সদস্য দিনাজপুর বোর্ডে দশ বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সাত নয়, দশ বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা রয়েছে।
শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এর দু-তিন দিন আগে উপজেলার ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র সর্টিং (বাছাই) হয়েছে। এ সময় উপজেলা পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে এ সময়ই কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান প্যাকেটসহ এসব প্রশ্ন বের করে নেন, যা পরে প্রশাসন তার কক্ষ থেকে এসব উদ্ধার করে।
সব সদস্যের যোগসাজশ ছাড়া একা কেন্দ্রসচিবের পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাজ করা সম্ভব নয়। এমনটিই মনে করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। যেসব বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের শঙ্কা করা হচ্ছে সেগুলো হলো : গণিত, কৃষিশিক্ষা, রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞান। এ ছাড়া সন্দেহের তালিকায় আছে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। এদিকে প্রথম ছটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে নতুন প্রশ্নে। আর বাকি চারটির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত চারটি পরীক্ষা বাতিল করেছে। বৃহস্পতিবারই বাতিল পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। নতুন রুটিন অনুযায়ী ১০ অক্টোবর গণিত, ১১ অক্টোবর কৃষিশিক্ষা, ১৩ অক্টোবর রসায়ন এবং ১৫ অক্টোবর পদার্থ বিজ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ ছাড়া উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু এ দুটি পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কারণ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পরীক্ষা দুটি নির্ধারিত আছে। এর আগেই এ পরীক্ষা দুটির প্রশ্ন ছাপানো সম্ভব।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় সরেজমিন কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া মাউশির নির্দেশে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমানের দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য তাকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া এ ঘটনায় পুলিশ নতুন করে আরও ৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। তারা গত বুধবার থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। তিনজনের মধ্যে আছেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন ও পদার্থবিজ্ঞানের হামিদুল ইসলাম। এ ছাড়া অফিস সহায়ক সুজন মিয়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ নিয়ে ৬ জন গ্রেপ্তার হলেন। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করছেন পরীক্ষা বিশেষজ্ঞরা। কেননা প্রশ্নপত্র উপজেলায় পৌঁছানোর পর পরীক্ষা শুরুর ২-৩ দিন আগে ‘উপজেলা পাবলিক পরীক্ষা কমিটি’র সদস্যদের সামনেই বাছাই করা হয়েছে। ওইদিন ছাড়া অন্য তারিখে প্রশ্ন ট্রেজারি থেকে সরানো সম্ভব নয়। কেননা, যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেদিন কেবল সেই প্রশ্ন নেওয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে এত সদস্যের সামনে কেন্দ্রসচিব প্রশ্ন কীভাবে সরালেন-এটি এখন বড় প্রশ্ন।
তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনায় অন্যরাও জড়িত থাকতে পারেন। তাই মামলার বাদী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের আসামি হবেন কি না, সেটাও তদন্তেই বেরিয়ে আসবে বলে মাউশি স‚ত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘পরীক্ষার দু-একদিন আগে প্রশ্নপত্র সর্টিং করা হয়। ম‚ল প্রশ্ন থাকে ফয়েল পেপারে, যার উভয় মুখ মেশিন দিয়ে লাগানো থাকে। এর ওপরে প্রশ্নসংখ্যা ও বিষয়ের নাম থাকে। আবার ফয়েল পেপারের খাম কাগজের আলাদা খামে থাকে। সেটি পরীক্ষা কমিটির সবার সামনে খুলে সর্টিং করা হয়। তাই ঘটনা যা ঘটার, তা পরীক্ষার আগেই ঘটে থাকতে পারে। কেননা অন্যদিন অন্য কোনো বিষয়ের প্রশ্নের খাম সরানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৬ জনকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে এক নম্বর আসামি লুৎফর রহমানকে বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী এই শিক্ষকের ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। তবে বিজ্ঞ বিচারক মো. সুমন আলী রিমান্ড ও জামিন শুনানির জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এ ঘটনায় ৪ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ ১০/১৫ জন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে বুধবারই পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স অ্যাক্ট ১৯৮০-এর ৪/১৩ ধারায় মামলা করা হয়। 
একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয়, যখন এর শিক্ষা কাঠামো এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্তরগুলো স্বচ্ছ ও সুগঠিত হয়। তাই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে রাষ্ট্রকে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষায় নতুন নিয়ম অনুযায়ী সচিব ব্যতীত অন্য কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা, এমনকি পরীক্ষার্থীরাও ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এটি অবশ্যই একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু জালিয়াতি রোধে তা যথোপযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কেননা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে সাধারণত পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডে মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে। অন্যান্য সদস্য হবেন বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা পুলিশ সুপার। সব থেকে কার্যকর পদক্ষেপ হল ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অজ¯্র আইন আছে, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করতে মনিটরিং সেলের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। প্রশ্ন ফাঁসকারী এবং প্রশ্ন গ্রহণকারী উভয়কে সমানভাবে অপরাধী গণ্য করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তবেই আইনের সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জালিয়াত চক্রকে ঠেকাতে পারছে না, তাই কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্রকে মেধার যতœ নিতে হবে দেশ এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। চীন, ভারত, কোরিয়া যেখানে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে বিশ্ব শাসন করতে চাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার অচলাবস্থাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না! হায়, কী দুভার্গ্য আমাদের! বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন। মানুষ সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। মেধার যথাযথ ম‚ল্যায়ন করা হবে। এজন্য রাষ্ট্র অতি দ্রæত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে।
দেশে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা কতটা প্রসারিত হয়েছে, তা বোঝা যায় শিক্ষক কর্তৃক প্রশ্নফাঁসের ঘটনা থেকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। সা¤প্রতিক সময়ে এর প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অহরহই ঘটেছে। এর আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে ম‚লত ডিজিটাল ডিভাইস তথা প্রযুক্তির মাধ্যমে।
কিন্তু এবারের ঘটনা আরও ন্যক্কারজনক। প্রশ্নফাঁসে সরাসরি শিক্ষক, এমনকি প্রধান শিক্ষকও যুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে দেশে কী ধরনের মানবসম্পদ তৈরি হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দিক বলেছেন, ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব? প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম, শুনলাম তিনিই প্রশ্নফাঁস করেছেন। তাহলে কোথায় বিশ্বাস রাখব? ছাত্ররা কী শিখবে?’
বস্তুত এ প্রশ্ন আমাদের সবার। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা একটি গুরুতর অপরাধ। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন স্বয়ং শিক্ষক যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনা সমাজের আশঙ্কাজনক অবক্ষয়েরও নির্দেশক। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা একদিকে যেমন জাতির মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সরকারী হিসাব মতে,বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পরীক্ষায় সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তীব্রতা লাভ করে আরো পরে। ২০১৪ সাল থেকে পিএসসি, জেএসসি, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মতো বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি পরীক্ষারও প্রশ্ন ফাঁস শুরু হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ একাধিকবার এসেছে।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সব কয়টি সরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে একাধিক রিপোর্ট পাওয়া গেলেও সরকার কর্তৃক বরাবরই এই দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এর কিছুদিন পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্ন ফাঁসে দোষীদের পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের শিগগিরই চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন।২০১৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষাটির তারিখ পরিবর্তন করা হলেও, অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পরেও এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে সরকার থেকেও একেক সময় একে ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। কখনো এই দাবি সম্প‚র্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। আবার কখনো আগের চেয়ে কম হারে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়।এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদেরকেও প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত বলে মন্তব্য করেছিলেন। এতদিন পরে শিক্ষা মন্ত্রীর কথা বাস্তবে প্রমানিত হলো।
এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে মন্ত্রণালয় অনেক সিরিয়াস ছিল। পরীক্ষা শুরুর আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, কেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, এমনকি কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারো হাতে মোবাইল পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এমনকি ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও হয়েছিল, যদিও পরে তা আর কার্যকর হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পুলিশও কিছু এলোমেলো ধরপাকড় করেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি হাইকোর্টে গেছে। রিট হয়েছে, হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এইসব করতে করতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না।
প্রশ্ন ফাঁস যদি বন্ধ না হয়, আপনার সকল চেষ্টাই আসলে অর্থহীন। ব্যাপারটা এখন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন ফাঁস চক্র যেন সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলছে। এখন আর অর্থনৈতিক লাভের জন্য কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন ফাঁস এখন কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এখন সরকারকে বিব্রত করার জন্যই করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈতিকতার শেকড় এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, কোচিংবাজ, প্রাইভেটবাজ শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কাউকে সেখান থেকে আলাদা করা কঠিন। তাই নীতিকথায় কাজ হবে না। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে চাই কঠোর আইনি ব্যবস্থা। এখানেই লুকিয়ে আছে, প্রশ্ন ফাঁস রহস্যের সমাধান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর আন্তরিক চেষ্টাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। এখানে মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। পুলিশকে সত্যিকার অর্থেই ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে মাঠে নামার নির্দেশনা দিতে হবে। 
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক উদ্যোগই পারে এই ভয়াবহ বিষ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার। কারণ শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যত। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে বাঁচাতে হবে যে কোনো উপায়ে। মানুষের নৈতিকতা, মানবিক ম‚ল্যবোধ ও মানসিকতা উন্নত করতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে হবে সামাজিকভাবে।
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অর্থের লোভে উচ্চশিক্ষিত মানুষও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি এখন মহাদুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে।

লেখক: সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা গোদাগাড়ী উপজেলা শাখা ও প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী।

মো: হায়দার আলী 

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২,  10:26 PM

news image

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, যে দেশের মানুষ যত শিক্ষিত সে দেশ তত উন্নত। বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাডেমিক ভবণ, রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ মানসম্মত উন্নত পাঠদান নিশ্চিত করতে নানাম‚খি উদ্দ্যেগ গ্রহন করেছেন। কিন্তু একটি কুচক্রীমহ সরকারের সুনাম, উন্নয়ন নষ্ট করে দিচ্ছেন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর থেকে আরো কঠোর হতে হবে। সে যে দলের, মতের হউক না কেন? কোনভাবে ছাড় দেয়া যাবে না। 
প্রশ্ন ফাঁসের নিউজটি পড়তে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকগণ জড়িত। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সন্দেহের তালিকায় কমিটির সব সদস্য দিনাজপুর বোর্ডে দশ বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সাত নয়, দশ বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা রয়েছে।
শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এর দু-তিন দিন আগে উপজেলার ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র সর্টিং (বাছাই) হয়েছে। এ সময় উপজেলা পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে এ সময়ই কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান প্যাকেটসহ এসব প্রশ্ন বের করে নেন, যা পরে প্রশাসন তার কক্ষ থেকে এসব উদ্ধার করে।
সব সদস্যের যোগসাজশ ছাড়া একা কেন্দ্রসচিবের পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাজ করা সম্ভব নয়। এমনটিই মনে করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। যেসব বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের শঙ্কা করা হচ্ছে সেগুলো হলো : গণিত, কৃষিশিক্ষা, রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞান। এ ছাড়া সন্দেহের তালিকায় আছে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। এদিকে প্রথম ছটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে নতুন প্রশ্নে। আর বাকি চারটির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত চারটি পরীক্ষা বাতিল করেছে। বৃহস্পতিবারই বাতিল পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। নতুন রুটিন অনুযায়ী ১০ অক্টোবর গণিত, ১১ অক্টোবর কৃষিশিক্ষা, ১৩ অক্টোবর রসায়ন এবং ১৫ অক্টোবর পদার্থ বিজ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ ছাড়া উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু এ দুটি পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কারণ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পরীক্ষা দুটি নির্ধারিত আছে। এর আগেই এ পরীক্ষা দুটির প্রশ্ন ছাপানো সম্ভব।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় সরেজমিন কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া মাউশির নির্দেশে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমানের দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য তাকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া এ ঘটনায় পুলিশ নতুন করে আরও ৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। তারা গত বুধবার থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। তিনজনের মধ্যে আছেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন ও পদার্থবিজ্ঞানের হামিদুল ইসলাম। এ ছাড়া অফিস সহায়ক সুজন মিয়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ নিয়ে ৬ জন গ্রেপ্তার হলেন। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করছেন পরীক্ষা বিশেষজ্ঞরা। কেননা প্রশ্নপত্র উপজেলায় পৌঁছানোর পর পরীক্ষা শুরুর ২-৩ দিন আগে ‘উপজেলা পাবলিক পরীক্ষা কমিটি’র সদস্যদের সামনেই বাছাই করা হয়েছে। ওইদিন ছাড়া অন্য তারিখে প্রশ্ন ট্রেজারি থেকে সরানো সম্ভব নয়। কেননা, যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেদিন কেবল সেই প্রশ্ন নেওয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে এত সদস্যের সামনে কেন্দ্রসচিব প্রশ্ন কীভাবে সরালেন-এটি এখন বড় প্রশ্ন।
তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনায় অন্যরাও জড়িত থাকতে পারেন। তাই মামলার বাদী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের আসামি হবেন কি না, সেটাও তদন্তেই বেরিয়ে আসবে বলে মাউশি স‚ত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘পরীক্ষার দু-একদিন আগে প্রশ্নপত্র সর্টিং করা হয়। ম‚ল প্রশ্ন থাকে ফয়েল পেপারে, যার উভয় মুখ মেশিন দিয়ে লাগানো থাকে। এর ওপরে প্রশ্নসংখ্যা ও বিষয়ের নাম থাকে। আবার ফয়েল পেপারের খাম কাগজের আলাদা খামে থাকে। সেটি পরীক্ষা কমিটির সবার সামনে খুলে সর্টিং করা হয়। তাই ঘটনা যা ঘটার, তা পরীক্ষার আগেই ঘটে থাকতে পারে। কেননা অন্যদিন অন্য কোনো বিষয়ের প্রশ্নের খাম সরানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৬ জনকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে এক নম্বর আসামি লুৎফর রহমানকে বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী এই শিক্ষকের ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। তবে বিজ্ঞ বিচারক মো. সুমন আলী রিমান্ড ও জামিন শুনানির জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এ ঘটনায় ৪ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ ১০/১৫ জন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে বুধবারই পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স অ্যাক্ট ১৯৮০-এর ৪/১৩ ধারায় মামলা করা হয়। 
একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয়, যখন এর শিক্ষা কাঠামো এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্তরগুলো স্বচ্ছ ও সুগঠিত হয়। তাই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে রাষ্ট্রকে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষায় নতুন নিয়ম অনুযায়ী সচিব ব্যতীত অন্য কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা, এমনকি পরীক্ষার্থীরাও ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এটি অবশ্যই একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু জালিয়াতি রোধে তা যথোপযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কেননা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে সাধারণত পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডে মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে। অন্যান্য সদস্য হবেন বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা পুলিশ সুপার। সব থেকে কার্যকর পদক্ষেপ হল ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অজ¯্র আইন আছে, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করতে মনিটরিং সেলের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। প্রশ্ন ফাঁসকারী এবং প্রশ্ন গ্রহণকারী উভয়কে সমানভাবে অপরাধী গণ্য করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তবেই আইনের সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জালিয়াত চক্রকে ঠেকাতে পারছে না, তাই কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্রকে মেধার যতœ নিতে হবে দেশ এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। চীন, ভারত, কোরিয়া যেখানে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে বিশ্ব শাসন করতে চাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার অচলাবস্থাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না! হায়, কী দুভার্গ্য আমাদের! বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন। মানুষ সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। মেধার যথাযথ ম‚ল্যায়ন করা হবে। এজন্য রাষ্ট্র অতি দ্রæত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে।
দেশে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা কতটা প্রসারিত হয়েছে, তা বোঝা যায় শিক্ষক কর্তৃক প্রশ্নফাঁসের ঘটনা থেকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। সা¤প্রতিক সময়ে এর প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অহরহই ঘটেছে। এর আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে ম‚লত ডিজিটাল ডিভাইস তথা প্রযুক্তির মাধ্যমে।
কিন্তু এবারের ঘটনা আরও ন্যক্কারজনক। প্রশ্নফাঁসে সরাসরি শিক্ষক, এমনকি প্রধান শিক্ষকও যুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে দেশে কী ধরনের মানবসম্পদ তৈরি হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দিক বলেছেন, ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব? প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম, শুনলাম তিনিই প্রশ্নফাঁস করেছেন। তাহলে কোথায় বিশ্বাস রাখব? ছাত্ররা কী শিখবে?’
বস্তুত এ প্রশ্ন আমাদের সবার। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা একটি গুরুতর অপরাধ। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন স্বয়ং শিক্ষক যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনা সমাজের আশঙ্কাজনক অবক্ষয়েরও নির্দেশক। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা একদিকে যেমন জাতির মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সরকারী হিসাব মতে,বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পরীক্ষায় সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তীব্রতা লাভ করে আরো পরে। ২০১৪ সাল থেকে পিএসসি, জেএসসি, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মতো বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি পরীক্ষারও প্রশ্ন ফাঁস শুরু হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ একাধিকবার এসেছে।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সব কয়টি সরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে একাধিক রিপোর্ট পাওয়া গেলেও সরকার কর্তৃক বরাবরই এই দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এর কিছুদিন পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্ন ফাঁসে দোষীদের পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের শিগগিরই চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন।২০১৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষাটির তারিখ পরিবর্তন করা হলেও, অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পরেও এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে সরকার থেকেও একেক সময় একে ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। কখনো এই দাবি সম্প‚র্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। আবার কখনো আগের চেয়ে কম হারে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়।এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদেরকেও প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত বলে মন্তব্য করেছিলেন। এতদিন পরে শিক্ষা মন্ত্রীর কথা বাস্তবে প্রমানিত হলো।
এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে মন্ত্রণালয় অনেক সিরিয়াস ছিল। পরীক্ষা শুরুর আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, কেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, এমনকি কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারো হাতে মোবাইল পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এমনকি ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও হয়েছিল, যদিও পরে তা আর কার্যকর হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পুলিশও কিছু এলোমেলো ধরপাকড় করেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি হাইকোর্টে গেছে। রিট হয়েছে, হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এইসব করতে করতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না।
প্রশ্ন ফাঁস যদি বন্ধ না হয়, আপনার সকল চেষ্টাই আসলে অর্থহীন। ব্যাপারটা এখন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন ফাঁস চক্র যেন সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলছে। এখন আর অর্থনৈতিক লাভের জন্য কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন ফাঁস এখন কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এখন সরকারকে বিব্রত করার জন্যই করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈতিকতার শেকড় এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, কোচিংবাজ, প্রাইভেটবাজ শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কাউকে সেখান থেকে আলাদা করা কঠিন। তাই নীতিকথায় কাজ হবে না। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে চাই কঠোর আইনি ব্যবস্থা। এখানেই লুকিয়ে আছে, প্রশ্ন ফাঁস রহস্যের সমাধান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর আন্তরিক চেষ্টাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। এখানে মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। পুলিশকে সত্যিকার অর্থেই ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে মাঠে নামার নির্দেশনা দিতে হবে। 
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক উদ্যোগই পারে এই ভয়াবহ বিষ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার। কারণ শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যত। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে বাঁচাতে হবে যে কোনো উপায়ে। মানুষের নৈতিকতা, মানবিক ম‚ল্যবোধ ও মানসিকতা উন্নত করতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে হবে সামাজিকভাবে।
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অর্থের লোভে উচ্চশিক্ষিত মানুষও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি এখন মহাদুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে।

লেখক: সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা গোদাগাড়ী উপজেলা শাখা ও প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, গোদাগাড়ী, রাজশাহী।