প্রত্যেক খেয়ানতকারীর স্থান হবে জাহান্নাম
অনলাইন ডেস্ক
৩০ অক্টোবর, ২০২২, 11:43 PM
প্রত্যেক খেয়ানতকারীর স্থান হবে জাহান্নাম
উহুদ যুদ্ধের সময় যে তীরন্দাজরা ঘাঁটি ছেড়ে গনীমতের মাল একত্র করার জন্য চলে এসেছিলেন, তাঁদের ধারণা ছিল, আমরা যদি (মাল জমা করার জন্য) পৌঁছতে না পারি, তাহলে সমস্ত গনীমতের মাল অন্যরা নিয়ে নেবে। তাই তাঁদেরকে চেতনা দেওয়া হচ্ছে যে, গনীমতের মালে তোমাদের কোনো অংশ থাকবে না এ রকম ধারণা তোমরা কীভাবে করে নিলে? তোমাদের কি মহান নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমানতদারী ও তাঁর বিশ্বস্ততার উপর ভরসা নেই? মনে রেখো, একজন নবীর দ্বারা কোনো প্রকারের খেয়ানত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, খেয়ানত হল নবুয়তপরিপন্থী জিনিস। যদি নবিই খেয়ানতকারী ও আত্মসাৎকারী হয়ে যান, তাহলে তাঁর নবুয়তের উপর বিশ্বাস কিভাবে করা যেতে পারে? খেয়ানত করা হলো মহাপাপ। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসসমূহে কঠোরভাবে খেয়ানতের নিন্দা করা হয়েছে। কোরআনের আয়াতে বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে-
وَ مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّغُلَّ ؕ وَ مَنۡ یَّغۡلُلۡ یَاۡتِ بِمَا غَلَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ
আর কোন নবির জন্য উচিত নয় যে, সে খেয়ানত করবে। আর যে খেয়ানত করবে, কেয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে; যা সে খেয়ানত করেছে। এরপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেওয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬১)
আয়াতের সারসংক্ষেপ
আর নবির পক্ষে শোভনীয় নয় যে, তিনি খেয়ানত করবেন (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ যে লোক খেয়ানতকারী কেয়ামতের ময়দানে সে লাঞ্ছিত হবে। কারণ, যে লোক খেয়ানত করবে সে তার খেয়ানতকৃত বস্তু নিয়ে কেয়ামতের দিন (হাশরের ময়দানে) উপস্থিত করবে। (যাতে সমগ্র সৃষ্টি তার খেয়ানতের বিষয়টি অবহিত হতে পারে এবং সবার সামনে যেন সে লাঞ্ছিত হতে পারে। এরপর (কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর) এই খেয়ানতকারীদের প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের বদলা (জাহান্নামের মধ্যে) পাবে। আর তাদের উপর একটুও অন্যায় করা হবে না। অপরাধের অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হবে না। আয়াতে গলুলের এক অর্থ হলো- খেয়ানত করা, জোর করে দখল করে নেওয়া। সে হিসেবেই এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে বড় গলুল তথা খেয়ানত হলো এক বিঘত জমিন নেওয়া। তোমরা দুজন লোককে কোন জমিনের বা ঘরের প্রতিবেশি দেখতে পাবে। তারপর তাদের একজন তার সঙ্গীর অংশের এক বিঘত জমিন কেটে নেয়। যদি কেউ এভাবে জমিন কেটে নেয় তবে সে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত সাত জমিন গলায় পেঁচিয়ে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
غلول ‘গলুল’ এর অন্য অর্থ সরকারী সম্পত্তি থেকে কোনো কিছু গোপন করা। গনীমতের মালও সরকারি সম্পদ। সুতরাং তা থেকে চুরি করা মহাপাপ। কোনো নবির পক্ষে এমন পাপের সম্ভাব্যতা নেই। আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গনীমতের মাল চুরি করার বিষয়টিও এসে গেছে। ঘটনাটি ছিল এই যে, বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মালের মধ্যে থেকে একটি চাদর খোয়া যায়। কোনো কোনো লোক বললো, হয়ত সেটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে থাকবেন।’(তিরমিজি ৩০০৯, আবু দাউদ ৩৯৭১) এসব কথা যারা বলত তারা যদি মুনাফেক হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। আর তা কোন অবুঝ মুসলমানের পক্ষে বলাও অসম্ভব নয়। তবে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, সে হয়ত মনে করে থাকবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়, যাতে غلول বা গনীমতের মালের ব্যাপারে অনধিকার চর্চার ভয়াবহতা এবং কেয়ামতের দিন সে জন্য কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, কোন নবি সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে, তিনিই এহেন পাপ কাজ করে থাকবেন, একান্তই অনর্থক ধৃষ্টতা। কারণ, নবিগণ যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত। এখানে একটা বিষয় জানা আবশ্যক যে, গনীমতের মাল চুরি করা কিংবা তাতে খেয়ানত করা বা সরকারী সম্পদ থেকে কোনো কিছু আত্মসাৎ করা, সাধারণ চুরি অথবা খেয়ানত অপেক্ষা বেশি পাপের কাজ। কারণ, এ সম্পদের সাথে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সংযুক্ত থাকে। কাজেই যে লোক এতে চুরি করবে, সে চুরি করবে শত-সহস্ৰ লোকের সম্পদ। যদি কখনো কোনো সময় তার মনে তা সংশোধন করার খেয়াল হয়, তখন সবাইকে তাদের অধিকার ফিরিযে দেওয়া কিংবা সবার কাছ থেকে ক্ষমা নেওয়া একান্তই দুরূহ ব্যাপার। পক্ষান্তরে অন্যান্য সাধারণ চুরির মালের মালিক সাধারণত পরিচিত ও নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। কখনও কোনো সময় আল্লাহ যদি তওবাহ করার তাওফিক দান করেন, তবে তার হক আদায় করে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে মুক্ত হতে পারে। সে কারণেই কোনো এক যুদ্ধে এক লোক যখন কিছু পশম নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল, গনীমতের মাল বন্টন করার কাজ শেষ হয়ে গেলে যখন তার মনে হল, তখন সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে উপস্থিত হল। তিনি রহমাতুললিল আলামীন এবং উম্মতের জন্য পিতা-মাতা অপেক্ষা সদয় হওয়া সত্বেও তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিলেন যে, এখন এগুলো কেমন করে আমি সমস্ত সেনাবাহিনীর মাঝে বন্টন করবো? কাজেই কেয়ামতের দিনই তুমি এগুলো নিয়ে উপস্থিত হইও।’ (ইবনে হিব্বান ৪৮৫৮, মুসনাদে আহমাদ ২/২১৩, ৬/৪২৮) তাছাড়া গনীমতের মাল বা সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ করার ব্যাপারটি অন্যান্য চুরি অপেক্ষা কঠিন পাপ হওয়ার আরও একটি কারণ এই যে, হাশরের ময়দানে যেখানে সমগ্র সৃষ্টি সমবেত হবে, সবার সামনে তাকে সেখানে এমনভাবে লাঞ্ছিত করা হবে যে, চুরি করা বস্তু-সামগ্রী তার কাঁধে চাপানো থাকবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘দেখো, কেয়ামতের দিন কারো কাঁধে একটি উট চাপানো অবস্থায় থাকবে এবং ঘোষণা করা হবে যে, এ লোক গনীমতের মালের উট চুরি করেছিল, এমন যেন না হয়। যদি সে লোক আমার শাফায়াত কামনা করে, তবে আমি তাকে পরিস্কার ভাষায় জবাব দিয়ে দেব যে, আমি আল্লাহর যা কিছু নির্দেশ পেয়েছিলাম, তা সবই পৌঁছে দিয়েছিলাম, এখন আমি কিছুই করতে পারব না।’ (বুখারি ৩০৭৩)
মনে রাখা জরুরি
মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ওয়াকফের মালের অবস্থাও একই রকম, যাতে হাজার-হাজার মুসলিমের চাঁদা বা দান অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমাও যদি করাতে হয়, তবে কার কাছ থেকে ক্ষমা করাবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্ত হাদিয়া বা উপঢৌকণ গলুলের শামিল।’ (মুসনাদে আহমাদ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ দেন। সে ফিরে এসে বলল, এগুলো তোমাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ কি হলো কর্মচারীর তাকে আমরা কোনো কাজে পাঠাই পরে সে এসে বলে, এগুলো তোমাদের আর ওগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। সে কেন তার বাবা-মায়ের ঘরে বসে দেখে না যে, তার জন্য হাদিয়া আসে কিনা? যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার শপথ করে বলছি, যে কেউ এর থেকে কিছু নেবে কেয়ামতের দিন সেটাই সে তার কাঁধে নিয়ে আসবে।’ (বুখারি ৬৯৭৯, মুসলিম ১৮৩২)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘হে মানুষ সকল! তোমাদের কাউকে কোনো কাজে লাগালে যদি সে আমাদের থেকে কিছু লুকায় তবে সে তা কেয়ামতের দিন সঙ্গে নিয়ে আসবে।’ (মুসলিম ১৮৩৩)
হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিনিসপত্রের দায়িত্বে এক লোক ছিল, তাকে কারকারাহ বলা হতো, হঠাৎ করে সে মারা গেল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে তো জাহান্নামে গেছে। লোকেরা তার জিনিসপত্র তল্লাশী করে দেখতে পেল যে, সে একটি জামা চুরি করেছে।’ (বুখারি ৩০৭৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আয়াতের শিক্ষা নিজেদের বাস্তব জীবনে আমল করার তাওফিক দান করুন। খেয়ানত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
অনলাইন ডেস্ক
৩০ অক্টোবর, ২০২২, 11:43 PM
উহুদ যুদ্ধের সময় যে তীরন্দাজরা ঘাঁটি ছেড়ে গনীমতের মাল একত্র করার জন্য চলে এসেছিলেন, তাঁদের ধারণা ছিল, আমরা যদি (মাল জমা করার জন্য) পৌঁছতে না পারি, তাহলে সমস্ত গনীমতের মাল অন্যরা নিয়ে নেবে। তাই তাঁদেরকে চেতনা দেওয়া হচ্ছে যে, গনীমতের মালে তোমাদের কোনো অংশ থাকবে না এ রকম ধারণা তোমরা কীভাবে করে নিলে? তোমাদের কি মহান নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমানতদারী ও তাঁর বিশ্বস্ততার উপর ভরসা নেই? মনে রেখো, একজন নবীর দ্বারা কোনো প্রকারের খেয়ানত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, খেয়ানত হল নবুয়তপরিপন্থী জিনিস। যদি নবিই খেয়ানতকারী ও আত্মসাৎকারী হয়ে যান, তাহলে তাঁর নবুয়তের উপর বিশ্বাস কিভাবে করা যেতে পারে? খেয়ানত করা হলো মহাপাপ। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসসমূহে কঠোরভাবে খেয়ানতের নিন্দা করা হয়েছে। কোরআনের আয়াতে বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে-
وَ مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّغُلَّ ؕ وَ مَنۡ یَّغۡلُلۡ یَاۡتِ بِمَا غَلَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ
আর কোন নবির জন্য উচিত নয় যে, সে খেয়ানত করবে। আর যে খেয়ানত করবে, কেয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে; যা সে খেয়ানত করেছে। এরপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেওয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬১)
আয়াতের সারসংক্ষেপ
আর নবির পক্ষে শোভনীয় নয় যে, তিনি খেয়ানত করবেন (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ যে লোক খেয়ানতকারী কেয়ামতের ময়দানে সে লাঞ্ছিত হবে। কারণ, যে লোক খেয়ানত করবে সে তার খেয়ানতকৃত বস্তু নিয়ে কেয়ামতের দিন (হাশরের ময়দানে) উপস্থিত করবে। (যাতে সমগ্র সৃষ্টি তার খেয়ানতের বিষয়টি অবহিত হতে পারে এবং সবার সামনে যেন সে লাঞ্ছিত হতে পারে। এরপর (কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর) এই খেয়ানতকারীদের প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের বদলা (জাহান্নামের মধ্যে) পাবে। আর তাদের উপর একটুও অন্যায় করা হবে না। অপরাধের অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হবে না। আয়াতে গলুলের এক অর্থ হলো- খেয়ানত করা, জোর করে দখল করে নেওয়া। সে হিসেবেই এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে বড় গলুল তথা খেয়ানত হলো এক বিঘত জমিন নেওয়া। তোমরা দুজন লোককে কোন জমিনের বা ঘরের প্রতিবেশি দেখতে পাবে। তারপর তাদের একজন তার সঙ্গীর অংশের এক বিঘত জমিন কেটে নেয়। যদি কেউ এভাবে জমিন কেটে নেয় তবে সে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত সাত জমিন গলায় পেঁচিয়ে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
غلول ‘গলুল’ এর অন্য অর্থ সরকারী সম্পত্তি থেকে কোনো কিছু গোপন করা। গনীমতের মালও সরকারি সম্পদ। সুতরাং তা থেকে চুরি করা মহাপাপ। কোনো নবির পক্ষে এমন পাপের সম্ভাব্যতা নেই। আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গনীমতের মাল চুরি করার বিষয়টিও এসে গেছে। ঘটনাটি ছিল এই যে, বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মালের মধ্যে থেকে একটি চাদর খোয়া যায়। কোনো কোনো লোক বললো, হয়ত সেটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে থাকবেন।’(তিরমিজি ৩০০৯, আবু দাউদ ৩৯৭১) এসব কথা যারা বলত তারা যদি মুনাফেক হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। আর তা কোন অবুঝ মুসলমানের পক্ষে বলাও অসম্ভব নয়। তবে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, সে হয়ত মনে করে থাকবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয়, যাতে غلول বা গনীমতের মালের ব্যাপারে অনধিকার চর্চার ভয়াবহতা এবং কেয়ামতের দিন সে জন্য কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, কোন নবি সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে, তিনিই এহেন পাপ কাজ করে থাকবেন, একান্তই অনর্থক ধৃষ্টতা। কারণ, নবিগণ যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত। এখানে একটা বিষয় জানা আবশ্যক যে, গনীমতের মাল চুরি করা কিংবা তাতে খেয়ানত করা বা সরকারী সম্পদ থেকে কোনো কিছু আত্মসাৎ করা, সাধারণ চুরি অথবা খেয়ানত অপেক্ষা বেশি পাপের কাজ। কারণ, এ সম্পদের সাথে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সংযুক্ত থাকে। কাজেই যে লোক এতে চুরি করবে, সে চুরি করবে শত-সহস্ৰ লোকের সম্পদ। যদি কখনো কোনো সময় তার মনে তা সংশোধন করার খেয়াল হয়, তখন সবাইকে তাদের অধিকার ফিরিযে দেওয়া কিংবা সবার কাছ থেকে ক্ষমা নেওয়া একান্তই দুরূহ ব্যাপার। পক্ষান্তরে অন্যান্য সাধারণ চুরির মালের মালিক সাধারণত পরিচিত ও নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। কখনও কোনো সময় আল্লাহ যদি তওবাহ করার তাওফিক দান করেন, তবে তার হক আদায় করে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে মুক্ত হতে পারে। সে কারণেই কোনো এক যুদ্ধে এক লোক যখন কিছু পশম নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল, গনীমতের মাল বন্টন করার কাজ শেষ হয়ে গেলে যখন তার মনে হল, তখন সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে উপস্থিত হল। তিনি রহমাতুললিল আলামীন এবং উম্মতের জন্য পিতা-মাতা অপেক্ষা সদয় হওয়া সত্বেও তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিলেন যে, এখন এগুলো কেমন করে আমি সমস্ত সেনাবাহিনীর মাঝে বন্টন করবো? কাজেই কেয়ামতের দিনই তুমি এগুলো নিয়ে উপস্থিত হইও।’ (ইবনে হিব্বান ৪৮৫৮, মুসনাদে আহমাদ ২/২১৩, ৬/৪২৮) তাছাড়া গনীমতের মাল বা সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ করার ব্যাপারটি অন্যান্য চুরি অপেক্ষা কঠিন পাপ হওয়ার আরও একটি কারণ এই যে, হাশরের ময়দানে যেখানে সমগ্র সৃষ্টি সমবেত হবে, সবার সামনে তাকে সেখানে এমনভাবে লাঞ্ছিত করা হবে যে, চুরি করা বস্তু-সামগ্রী তার কাঁধে চাপানো থাকবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘দেখো, কেয়ামতের দিন কারো কাঁধে একটি উট চাপানো অবস্থায় থাকবে এবং ঘোষণা করা হবে যে, এ লোক গনীমতের মালের উট চুরি করেছিল, এমন যেন না হয়। যদি সে লোক আমার শাফায়াত কামনা করে, তবে আমি তাকে পরিস্কার ভাষায় জবাব দিয়ে দেব যে, আমি আল্লাহর যা কিছু নির্দেশ পেয়েছিলাম, তা সবই পৌঁছে দিয়েছিলাম, এখন আমি কিছুই করতে পারব না।’ (বুখারি ৩০৭৩)
মনে রাখা জরুরি
মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ওয়াকফের মালের অবস্থাও একই রকম, যাতে হাজার-হাজার মুসলিমের চাঁদা বা দান অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমাও যদি করাতে হয়, তবে কার কাছ থেকে ক্ষমা করাবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্ত হাদিয়া বা উপঢৌকণ গলুলের শামিল।’ (মুসনাদে আহমাদ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ দেন। সে ফিরে এসে বলল, এগুলো তোমাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ কি হলো কর্মচারীর তাকে আমরা কোনো কাজে পাঠাই পরে সে এসে বলে, এগুলো তোমাদের আর ওগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। সে কেন তার বাবা-মায়ের ঘরে বসে দেখে না যে, তার জন্য হাদিয়া আসে কিনা? যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার শপথ করে বলছি, যে কেউ এর থেকে কিছু নেবে কেয়ামতের দিন সেটাই সে তার কাঁধে নিয়ে আসবে।’ (বুখারি ৬৯৭৯, মুসলিম ১৮৩২)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘হে মানুষ সকল! তোমাদের কাউকে কোনো কাজে লাগালে যদি সে আমাদের থেকে কিছু লুকায় তবে সে তা কেয়ামতের দিন সঙ্গে নিয়ে আসবে।’ (মুসলিম ১৮৩৩)
হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিনিসপত্রের দায়িত্বে এক লোক ছিল, তাকে কারকারাহ বলা হতো, হঠাৎ করে সে মারা গেল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে তো জাহান্নামে গেছে। লোকেরা তার জিনিসপত্র তল্লাশী করে দেখতে পেল যে, সে একটি জামা চুরি করেছে।’ (বুখারি ৩০৭৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আয়াতের শিক্ষা নিজেদের বাস্তব জীবনে আমল করার তাওফিক দান করুন। খেয়ানত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।